এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। রপ্তানি আয় বাড়ছে না। প্রবাসী আয় নিম্নমুখী। বিনিয়োগ স্থবির। কলকারখানায়ও গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি। সরকার নিত্যপণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে, আমদানি করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। মন্ত্রীরা বলছেন, সিন্ডিকেট বাজার অস্থিতিশীল করছে। কিন্তু সেই সিন্ডিকেটকে ধরতে পারছে না। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে চুনোপুঁটিদের ধরছে। কিন্তু রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না বা নিচ্ছে না।
সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এত দিন স্বীকারই করতে চাননি দেশে কোনো সমস্যা আছে। যেকোনো বেসরকারি জরিপ ও গবেষণা প্রতিবেদন তঁারা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতেন। কিন্তু একটানা ১৫ বছর দেশ শাসনের পর সরকার বুঝতে পারছে অর্থনীতি ভালোভাবে চলছে না। এ জন্য তাঁরা অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নিচ্ছেন।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বসেছিলেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, ‘টাকা ছাপিয়ে সরকার ও ব্যাংককে ঋণ দেওয়া যাবে না। বরং সরকারকে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর দিকেই নজর দিতে হবে।’
কিন্তু রপ্তানি আয় ও প্রাবাসী আয় বাড়বে কীভাবে, যদি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকে। বাংলাদেশের রাজনীতি সব সময়ই অস্থির ও অনিশ্চিত। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সেই অনিশ্চয়তা আরও বাড়ছে। নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল অনড় অবস্থানে। সরকার বলছে, বর্তমান সংবিধানের অধীনেই নির্বাচন হবে। বিরোধী দলের দাবি, বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে কোনো নির্বাচন হবে না।
গতকাল শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। এখন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে প্রশ্ন, তাঁরা একসঙ্গে বসে সংকটের সমাধান করবেন, নাকি সংঘাতের পথ বেছে নেবেন?
এক বছর ধরেই দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি চলছে। দেশে এত সমস্যা, এ নিয়ে রাজনীতিকদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁরা ভাবেন ক্ষমতায় থাকতে বা আসতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান হবে।
বৃহস্পতিবার ভৈরবে বিএনপির রোডমার্চের আগে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন, সরকারকে ফেলে দিতে ভবিষ্যতে হরতাল–অবরোধের প্রয়োজন হলে তাঁরা সেটি করতে প্রস্তুত আছেন কি না। তাঁরা হাত তুলে জানিয়েছেন, প্রস্তুত আছেন। দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ভোট চোরদের বিদায় করতে চট্টগ্রামে সুনামি তৈরি করতে হবে।’
অন্যদিকে সরকারি দলের নেতারা বলেছেন, জনগণের শান্তি বিনষ্ট হয়, এমন কোনো কর্মসূচি নিলে সেটি শক্ত হাতে দমন করা হবে। সমস্যা হলো আমাদের দেশে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে শান্তির সংজ্ঞাও বদলে যায়। আজ আওয়ামী লীগের কাছে হরতাল–অবরোধ শান্তি বিনষ্টকারী কর্মসূচি। অথচ বিরোধী দলে থাকতে তারা এই ধরনের কর্মসূচি হামেশা পালন করেছে।
ধারণা করি, বিএনপি ও এর সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল–অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিলে সরকারও বসে থাকবে না। নব্বই দশকের শেষ দিকে বিরোধী দলের হরতালের দিনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা শান্তি মিছিল নিয়ে রাজপথ গরম রাখতেন। দুই দলের মধ্যে সংঘাত হতো।
বিএনপির লাগাতার কর্মসূচি দেখে মনে হয়, তারা আর বেশি সময় দিতে চাইছে না। অক্টোবরের মধ্যে চূড়ান্ত অবস্থায় যেতে চায়, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই। নির্বাচন কমিশন নভেম্বরের শুরুতে তফসিল ঘোষণার আভাস দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রশ্ন হলো নির্বাচনটি কেমন করে হবে? ২০১৪ ও ২০১৮–এর মডেলে? ২০১৪–এর মডেল হলো নিবন্ধিত অধিকাংশ দলকে রাইরে রেখে নির্বাচন। যদি সরকার সে রকম একতরফা নির্বাচন না চায়, তাহলে বিরোধী দলের সঙ্গে তাদের একটা বোঝাপড়ায় আসতেই হবে। সেটি হতে পারে সংবিধানের ভেতরে কিংবা সংবিধান সংশোধন করে। ১৯৯১ সালের নির্বাচন তো স্বৈরাচারী এরশাদের সংবিধানের অধীনে হয়েছিল।
এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনেরও দায়িত্ব আছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল একাধিকবার বলেছেন, বিএনপির মতো একটি বড় দল অংশ না নিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। কিন্তু নির্বাচনটি যাতে অংশগ্রহণমূলক হয়, সে জন্য তাঁরা কী করছেন, সেটাও দেশবাসী জানতে চায়। সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিএনপি কিন্তু প্রথমে নির্বাচনে আসতে চায়নি।
আবার নির্বাচনে অংশগ্রহণের ফল যদি ২০১৮–এর পুনরাবৃত্তি হয়, তাহলে বিরোধী দল কেন নির্বাচনে যাবে। আওয়ামী লীগের নেতা–মন্ত্রীরা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আশ্বাস মুখে দিলেও কাজ হচ্ছে উল্টো। একটি দলের হাজার হাজার নেতা–কর্মীকে যদি লাখ লাখ মামলার খড়্গ নিয়ে ঘুরতে হয়, তঁারা নির্বাচন করবেন কীভাবে?
নির্বাচন নিয়ে যখন দুই পক্ষের নেতারা রাজপথ গরম করছেন, তখনই খবর এল ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। তারা বলেছে, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ হবে কি না, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালকে লেখা চিঠিতে সিদ্ধান্তের কথা জানান ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি।
অন্যদিকে আগামী ৭ থেকে ১৩ অক্টোবর আসছে মার্কিন প্রাক্–পর্যবেক্ষক দল। তারা বাংলাদেশের নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না, সে ব্যাপারে যাচাই করবে। বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশের কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যৌথ প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে, এ রকম কথা ভাবা যায়?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ৫২ বছরেও নির্বাচনের বিষয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।
এ জন্য তাঁরা বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ছুটে যান। বিদেশি কূটনীতিকেরাও এখানে দৌড়ঝাঁপ করেন। এসব কি আমাদের জন্য লজ্জাজনক নয়?
বর্তমানে দেশে নির্বাচন নিয়ে যে সংকট, সেটা আসলে গণতন্ত্রেরই সংকট। আমরা ২০২৪ সালেও যদি একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন না করতে পারি, তাহলে সংঘাত অনিবার্য। আর সেই রাজপথের সংঘাতে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি—যে–ই জিতুক, হারবে বাংলাদেশের মানুষ ও গণতন্ত্র।
গতকাল শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। এখন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে প্রশ্ন, তাঁরা একসঙ্গে বসে সংকটের সমাধান করবেন, নাকি সংঘাতের পথ বেছে নেবেন?
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি