দিনে অথবা রাতে হুট করেই পথিমধ্যে উদয় হচ্ছে নম্বরপ্লেটবিহীন সাদা রঙের মাইক্রোবাস। এ যেন সাক্ষাৎ যমদূত। পথরোধ করে মুখোশধারীরা মাইক্রোবাস থেকে নেমে বিএনপি-জামায়াতের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর গুলি করে, পিটিয়ে হত্যা করে বা আহত করে রাস্তার পাশে বা খেতে বা জঙ্গলে ফেলে রেখে যাচ্ছে। অথবা হেলমেট ও মুখোশ পরে এসে বিএনপি নেতা–কর্মীদের ঘরবাড়িতে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা করছে। লুটপাটও চালানো হচ্ছে।
এ ধরনের ঘটনায় সম্প্রতি কয়েকজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৫ জনের মতো। নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যায় তারতম্য থাকতে পারে। কারণ, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রকৃত চিত্র ভিন্নও হতে পারে।
কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ওপর মুখোশ পরে হামলার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হামলা শুরু হয়। লক্ষ্মীপুরে হামলা হয়েছে। রাজশাহীতে এ ধরনের চোরাগোপ্তা হামলায় দুই চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুজন। আহত দুজনকে মৃত ভেবে হামলাকারীরা ফেলে গিয়েছিল। রংপুরে হামলা করে এক ইউপি চেয়ারম্যানকে হত্যা করা হয়েছে। নাটোরে এ মাসেই চোরাগোপ্তা হামলা হয়েছে কমপক্ষে ৯টি। শনিবার নওগাঁয় মাস্ক ও হেলমেট পরে একজনকে পথরোধ করে রাতের আঁধারে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়েছে।
এমনিতেই দেশে নির্বাচনের আগে আগে সব মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিরোধীদের টানা কর্মসূচি চলছে। কর্মসূচিগুলোয় হানাহানি না হলেও কে বা কারা বাসে-ট্রেনে আগুন দিচ্ছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অগ্নিসংযোগের দায় বরাবরই অস্বীকার হয়েছে। বরং কমপক্ষে দুটি ঘটনায় গাড়িচালকেরা অভিযোগ করেছেন, পুলিশের সামনে ও গোয়েন্দা পুলিশের ভেস্ট পরে বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে।
প্রেসক্লাব ও হাইকোর্টের সামনে একটি বাসে চালক নিজেই আগুন দিয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অভিযোগ করেছেন; যদিও চালক অভিযোগ করেছিলেন, অবরোধকারী আগুন দিয়েছে। চালকের কথা শুনে প্রত্যক্ষদর্শীরা কথা বলতে শুরু করেন এবং জানান, চালক সঠিক তথ্য দিচ্ছেন না। এক রহস্যময় কারণে আগুন দেওয়া থামছে না। বিএনপির কিছু নেতাকে আগুন দেওয়ার ঘটনায় আটক করা হলেও জনমনে আস্থা ফিরে আসছে না; বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়াবহ রকমের শঙ্কা ও ভয় বিরাজ করছে।
এ অবস্থায় ক্রমাগত চোরাগোপ্তা হামলা এক ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব হামলার বিবরণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এগুলোর মধ্যে পুরোপুরি মিল না থাকলেও কমবেশি একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নম্বরবিহীন মাইক্রোবাসে করে হামলাকারী এসে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। অপহরণকারীরা মুখোশ, মাস্ক ও হেলমেট পরা ছিল, যাতে তাদের চিহ্নিত করা না যায়। বিএনপি-জামায়াত করার জন্য ভুক্তভোগীদের গালমন্দ করেছে অপহরণকারীরা।
ঢাকায় বিএনপি-জামায়াতের সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য থানায় নিয়ে পেটানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে। হামলায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি হাতুড়ি, লোহার রড, চাইনিজ কুড়ালসহ দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হাত-পা ভেঙে, পায়ের রগ কেটে হত্যা করা হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, হামলার শিকার সবাই বিএনপি ও জামায়াতের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মী।
হামলার প্রকৃতি, ধরন ও ধারাবাহিকতা দেখে বোঝাই যাচ্ছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমনটা করা হয়ে থাকতে পারে। বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাই জেলে; বরং একটি অংশ পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের মুখে আত্মগোপনে আছেন। এ অবস্থায় দল দুটির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকে ধরে রেখেছেন এবং চাঙা করার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে বিএনপির ঢাকার মহাসমাবেশগুলোয় বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীই তৃণমূল থেকে আসেন। এ অবস্থায় তৃণমূলকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে এ ধরনের হামলা করা হয়ে থাকতে পারে।
পুলিশের এই নির্লিপ্ত আচরণ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কোথাও একটা ‘কিন্তু’ থাকতে পারে। এই ‘কিন্তু’র উত্তর পুলিশকেই মিলাতে হবে। এটা পুলিশেরই দায়িত্ব। অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পার পাওয়া মুশকিল হবে। গুম ও বিনা বিচারে হত্যার দায় থেকে কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মুক্ত হতে পারেনি। র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন। এর রকম নজির ভূরি ভূরি আছে।
এ ছাড়া অন্য কোনো কারণে এ ধরনের চোরাগোপ্তা হামলার শঙ্কা কম। কারণ, প্রথমত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাঁরা হামলা, অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের বিরোধের কোনো তথ্য প্রকাশিত সংবাদগুলোয় পাওয়া যায়নি। একদম সাধারণ মানুষও হামলার শিকার হননি। স্থানীয় সন্ত্রাসী, ছিঁচকে অপরাধী, ছিনতাইকারী বা সংঘবদ্ধ কোনো অপরাধী চক্র এর সঙ্গে জড়িত হলে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বাইরে অন্য শ্রেণি ও পেশার লোকজন আক্রান্ত হতে পারতেন।
অর্থের জন্য হলে অপহরণ করার পর মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করত। অর্থ আদায়ের জন্য এ ধরনের হামলা করা হয়নি সম্ভবত। মুক্তিপণ নিয়ে কাউকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বা অর্থ দাবি করা হয়েছে—এমনটাও শোনা যায়নি। বরং ধরে নেওয়ার পর দু-একটি ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজন বা পরিবারের সদস্যদের ফোন করে ফেলে যাওয়া স্থানের কথা জানানো হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ বা ধরে নেওয়া হয়েছিল।
দুঃখজনক হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ হামলার কোনো সুরাহা করতে পারেনি। হামলার সঙ্গে জড়িত মাইক্রোবাস বা হামলাকারীদের শনাক্ত করতে পারেনি। বরং অভিযোগ নিতে পুলিশ গড়িমসি করেছে; সচরাচর পুলিশ যা করে থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এড়িয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছে। অভিযোগ গ্রহণে পুলিশের গড়িমসি ও তদন্তে অনীহা বা অগ্রগতি না হওয়ায় জনমনে নানা ধরনের প্রশ্নের উদ্রেক ঘটাতে পারে।
বিরোধী মত দমনে পুলিশকে যতটা আগ্রহী ও পারদর্শী মনে হয়, বিরোধীদের ওপর হামলার তদন্তে পুলিশকে ততটাই অনাগ্রহী মনে হচ্ছে। পুলিশের নজরদারিতে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের জীবন এখন তটস্থ। বিরোধী দলগুলোর অগুনতি নেতা-কর্মী পুলিশের অত্যাচারে ঘর ছড়া—এটা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়। এমনকি মৃত মানুষেরাও পুলিশের মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। মৃত ব্যক্তিদের গাড়ি পোড়ানো, দাঙ্গা-হাঙ্গামার মামলায় আসামি করা হচ্ছে। দশজন লোক কোথাও একসঙ্গে বসলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে পুলিশ আটক করছে। আর প্রায় ২০ দিন ধরে একের পর এক চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে, কিন্তু পুলিশ কিছুই করতে পারছে না।
পুলিশের এই নির্লিপ্ত আচরণ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। কোথাও একটা ‘কিন্তু’ থাকতে পারে। এই ‘কিন্তু’র উত্তর পুলিশকেই মিলাতে হবে। এটা পুলিশেরই দায়িত্ব। অজ্ঞাত দুর্বৃত্তদের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পার পাওয়া মুশকিল হবে। গুম ও বিনা বিচারে হত্যার দায় থেকে কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মুক্ত হতে পারেনি। র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন। এর রকম নজির ভূরি ভূরি আছে।
তাই চোরাগোপ্তা হামলার মামলা নিতে গড়িমসি করা ও দায়িত্বহীন আচরণের কারণে পুলিশের সংশ্লিষ্ট সদস্যরাও ভবিষ্যতে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারেন। তাই গড়িমসি না করে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করাই পুলিশের জন্য সঠিক কাজ হবে।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক