রাশিয়াতে কী ঘটছে, তা নিয়ে প্রত্যেকে কথা বলছেন। কিন্তু রাশিয়াতে যেটা ঘটেনি, তা নিয়ে প্রায় কেউই কোনো কথা বলছেন না।
ভাগনার গ্রুপের সহপ্রতিষ্ঠাতা ইয়েভগেনি প্রিগোশিন প্রায় আট হাজার সেনা সমবেত করেন এবং রুশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন। প্রিগোশিন তাঁর এ অভিযানকে ন্যায়ের জন্য অভিযাত্রা বলে অভিহিত করেন। তিনি সেনাবহর নিয়ে মস্কোর দিকে রওনা দেন। আপাতভাবে মনে হতে পারে, মস্কোয় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অধিকারে নেওয়াটাই প্রিগোশিনের উদ্দেশ্য ছিল। প্রিগোশিন রোস্তভ-অন-দনে অবস্থিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় কার্যালয় অধিকারে নিয়েছিলেন।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভকে অপসারণের দাবি করেছিলেন প্রিগোশিন।
এটা সবারই জানা যে, প্রিগোশিনের সেনাবহর মস্কো পর্যন্ত যায়নি। আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি উটকিনের নেতৃত্বে ভাগনার সেনাবহর মস্কো থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে থেমে যায়। প্রিগোশিন নিজে রোস্তভ-অন-দনে থেকে যান। সেখান থেকে প্রথমে তিনি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু পুতিন তাঁর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। এরপর প্রিগোশিন পুতিনের অধস্তন ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন।
ক্রেমলিনের কারও সমর্থন না পেয়ে ছোট সেনাবহরটি একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় এবং তাঁর পরিবার হুমকির মুখে পড়ায় প্রিগোশিন বিকল্প খুঁজতে শুরু করেন। শেষে পুতিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
দুই পক্ষে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, প্রিগোশিন ও তাঁর সঙ্গের আট হাজার সেনা বেলারুশে নির্বাসনে যেতে পারবেন। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলে নেওয়া হবে। বাকি ১২ হাজার ভাগনার সেনা রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন অথবা বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভাগনার সেনাদের অনেকে শর্ত মেনে নিয়েছেন।
এ অভিযান পরিচালনার জন্য প্রিগোশিন ছয় মাসের বেশি সময় ধরে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে আসছিলেন। সর্বশেষটি দেখা যায় বাখমুত যুদ্ধের সময়। প্রিগোশিন দাবি করেন, লড়াইয়ের জন্য তাঁকে যথেষ্ট গোলাবারুদ দেওয়া হচ্ছে না। সম্ভবত তাঁর এই দাবি ছিল মিথ্যা। প্রিগোশিন রাশিয়ার সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং বাখমুতে যুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তোলেন; যদিও এর কোনো একটি অভিযোগ সত্য নয়।
পুতিনের সামনে এখন মূল চ্যালেঞ্জটা হলো সরকারের ভেতরে তাঁর যেসব প্রতিপক্ষ রয়েছে, তাদের মোকাবিলা করা। প্রকাশ্যে তারা কিছু না বললেও পুতিন জানেন প্রিগোশিনের সঙ্গে কাদের যোগাযোগ রয়েছে।
গত কয়েক সপ্তাহ রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের দাবি ছিল, প্রিগোশিনসহ ভাগনারের প্রত্যেক সদস্যকে অবশ্যই রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কমান্ডের অধীন আনতে হবে। কিন্তু প্রিগোশিন তাতে অস্বীকৃতি জানান। এরপর প্রিগোশিন মনের মাধুরী মিশিয়ে কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দেন। দাবি করেন, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে তাঁর বাহিনী আক্রান্ত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি দুটি ভুয়া ভিডিও প্রকাশ করেন। একটা ভিডিওতে এক ব্যক্তিকে রাশিয়ার ‘উচ্ছন্নে যাওয়া সামরিক নেতৃত্বকে’ গালিগালাজ করতে দেখা যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার ও টেলিগ্রাফে অসমর্থিত সূত্রের কিছু খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এসব খবরে বলা হচ্ছে, গত জানুয়ারি মাস থেকে প্রিগোশিন ইউক্রেনীয় গোয়েন্দাদের (হার মো) সংস্পর্শে ছিলেন। কিছু সূত্রের দাবি, প্রিগোশিন আফ্রিকায় (সেখানে ভাগনার সেনাদের কর্মকাণ্ড রয়েছ) গিয়েছিলেন, সেখানে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়।
একই সঙ্গে এ সংবাদও ছড়িয়ে পড়েছে যে প্রিগোশিন তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে রাশিয়ার বিশেষ বাহিনীর কয়েকটি ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
একটা বিষয় মানুষ ভুলে গেছে যে ভাগনার গ্রুপ রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা জিআরইউর হাতে তৈরি। প্রিগোশিনের নিজের কোনো সামরিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও ভাগনারের আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি উটকিন ছিলেন জিআরইউ স্পেটসনাজের বিশেষ পরিচালক ছিলেন।
১৯৪৯ সাল কিংবা তার আগে থেকে স্পেটসনাজ ইউনিটটি সক্রিয়। এই ইউনিট শত্রুশিবিরে ঢুকে চোরাগোপ্তা হামলার জন্য সুপরিচিত। এমনকি শত্রুশিবিরে গিয়ে ছোট পারমাণবিক অস্ত্র রেখে আসার সামর্থ্যও তাদের আছে।
প্রিগোশিন আশা করেছিলেন, তাঁর এই বিদ্রোহের সমর্থনে পুলিশ, সেনা, গোয়েন্দাসহ হাজার হাজার সমর্থক রাস্তায় নেমে আসবেন। আমরা এখন জানি যে রাশিয়ায় কোনো অভ্যুত্থান হয়নি এবং প্রিগোশিনের গোপন মিশনে কেউই সমর্থন দেয়নি।
প্রকৃতপক্ষে, ভাগনার গ্রুপের অপারেশনাল কমান্ডার সের্গেই সুরোভিকিনও প্রিগোশিনকে সমর্থন দেননি। একটি ভিডিও বার্তায়, সুরোভিকিন বলেন, ভাগনারদের রাশিয়ায় প্রবেশ কিংবা রাশিয়ানদের সঙ্গে লড়াই করা উচিত নয়। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ডান হাতে দৃঢ়মুষ্টিতে একটি স্বয়ংক্রিয় পিস্তল ধরে আছেন সুরোভিকিন।
মস্কোর সমর্থন পায়নি বলে রাশিয়ানদের মধ্যে প্রিগোশিনের কদর কম, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। রোস্তভ-অন-দনে প্রিগোশিনকে স্বাগত জানানো হয়। সম্ভবত এর কারণ হলো, বাখমুত যুদ্ধের নায়ক হিসেবে প্রিগোশিনকে দেখেছেন তাঁরা।
কিন্তু ন্যায়ের অভিযাত্রার কারণে প্রিগোশিনের সেই বীরোচিত ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক লাগতে শুরু করেছে। সেনাবহর নিয়ে যাত্রা শুরুর আগে তিনি বলেছিলেন, এ অভিযাত্রায় কোনো রক্তপাত হবে না। কিন্তু তিনি খোলা মিথ্যা বলেছিলেন। রাশিয়ার একটি হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমান ভূপাতিত করেন ভাগনার সেনারা। এতে পাইলট, ক্রুসহ ৩৭ জন নিহত হয়েছেন।
প্রিগোশিন দুর্নীতি থেকেও মুক্ত নন। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিনি একটি চুক্তি করেছিলেন, তাতে বাজার থেকে অনেক বেশি মূল্যে জিনিসপত্র সরবরাহ শুরু করেছিলেন। চুক্তিটি রাশিয়াতে সেনাবহর নিয়ে প্রবেশের সপ্তাহখানেক আগে বাতিল করা হয়।
একটি অসমর্থিত সূত্রে জানা যাচ্ছে, শেষমেশ প্রিগোশিন খুব চমৎকার একটি চুক্তি করতে পেরেছেন। ইউক্রেন থেকে সরিয়ে রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে তাঁকে নিয়োজিত করা হতে পারে। এ ধরনের শর্ত মেনে না নেওয়া ছাড়া প্রিগোশিনের জন্য খুব বেশি বিকল্প পথ আর খোলা নেই।
পুতিনের সামনে এখন মূল চ্যালেঞ্জটা হলো সরকারের ভেতরে তাঁর যেসব প্রতিপক্ষ রয়েছে, তাদের মোকাবিলা করা। প্রকাশ্যে তারা কিছু না বললেও পুতিন জানেন প্রিগোশিনের সঙ্গে কাদের যোগাযোগ রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানা যাচ্ছে না, প্রিগোশিন ও তাঁর সহযোগী উটকিনের ভাগ্যে আসলে কী ঘটতে চলেছে। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়াতে গণ-অভ্যুত্থান এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে প্রকাশ্য বিভেদ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু পুতিন যদি প্রতারণার পথ না ছাড়েন, তাহলে সেটা ঘটতে পারে।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি এবং ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত