চাঁপাইনবাবগঞ্জের গাজলী বেগম। ৬২ বছরের এই বৃদ্ধার স্বামী মারা গেছেন ২৫ বছর আগে। ধানচালের চাতালে কাজ করে দুই সন্তানকে বড় করেছেন। ছোট ছেলের সংসারে দুই সন্তান। কিন্তু দুর্মূল্যের বাজারে ঠিকমতো সংসার চলে না। বাজার থেকে কম মূল্যে সরকারের খোলা বাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রির কর্মসূচি (ওএমএস) থেকে কিনতে এসেছেন চাল ও আটা। পণ্য প্রাপ্তির লাইনে ইট রেখে সিরিয়াল দিয়ে রেখেছেন আগের দিন সকাল সাতটায়। ইটের পাশে পিঁড়ি পেতে বসে আর পুরো রাত কাঁথা গায়ে জবুথবু শুয়ে অপেক্ষা করেছেন ওএমএসের ট্রাক আসার। ২৮ ঘণ্টা অপেক্ষার পর অবশেষে ৫ কেজি চাল ও ৫ কেজি আটা পান তিনি।
১৪ ডিসেম্বর প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে এ চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। শুধু গাজলী বেগমের মতো দিনমজুর নন, ওএমএসের লাইনে ঘণ্টা পেরিয়ে দিনের অপেক্ষা যাঁরা করছেন, তাঁদের মধ্যে বিদ্যালয়ে আয়ার চাকরি করেন এমন নারীও ছিলেন। কমমূল্যে খাদ্যপণ্য প্রাপ্তির লাইনে যেখান ৪০০ মানুষ দাঁড়িয়েছেন, সেখানে ২০০ জনের কাছে চাল-আটা বিক্রি করতে করতেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে খাদ্যপণ্য না পাওয়া মানুষেরা কাকুতি-মিনতি করছেন। আবার লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে বচসা ও ঝগড়ার চিত্রও নিয়মিত।
এর দুই দিন আগে (১২ ডিসেম্বর) ঢাকার সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল বস্তিতে ওএমএসের চাল ও আটা বিক্রির চিত্র প্রথম আলোর আরেকটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। জনপ্রতিনিধিদের তথ্য অনুযায়ী, বস্তিতে গাদাগাদি করে ৪০ হাজার পরিবার বাস করে। প্রতি পরিবারে সদস্যসংখ্যা গড়ে চারজন করে হলে কমবেশি ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের বসবাস সেখানে। বস্তিতে নিম্নআয়ের মানুষদের বসবাস। স্বাভাবিকভাবেই তাদের আয়ের সবচেয়ে বড় একটা অংশ ব্যয় হয় চালের পেছনে। সপ্তাহে তিন দিন সেখানে এক ট্রাক করে ওএমএসের খাদ্যপণ্য বিক্রি হয়। প্রতি ট্রাকে দুই হাজার কেজি চাল ও এক হাজার কেজি আটা বিক্রি হয়। দিনে সর্বোচ্চ ৪০০ পরিবার চাল ও ৫০০ পরিবার আটা পায়। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সেটা অপ্রতুল। তাই ওএমএসের ট্রাকের জন্য যেমন আগে থেকেই দীর্ঘ লাইন পড়ে আবার হুড়োহুড়ি ও প্রতিযোগিতা লেগেই থাকে। ঢাকা রেশনিং দপ্তরের প্রধান নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন বলেন, ‘আগে তো লোক হতো না। এখন প্রতিদিনই লোক বাড়ছে।’
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তারা বহুবার বলেছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে সরকার দাম ‘সমন্বয়’ করবে। কিন্তু বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বাজারে জ্বালানির তেলের দাম সমন্বয়ের নির্দিষ্ট কোনো সূত্র এখানে নেই। এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা থেকে যা পাওয়া যায় জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের দাম সমন্বয়ের অর্থ হলো দাম বাড়ানো। এত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানির মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু এখন সরাসরি সরকার হাতে নিয়ে নিয়েছে।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ভর্তুকি দামে সরকারের চাল-আটা বিক্রির লাইনে এই বাস্তবতা উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলাফল। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নানা বাস্তবতা মূল্যস্ফীতিতে অবদান রাখছে। কিন্তু গত জুলাই–আগস্টে জ্বালানির দাম একধাপে ৪০ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানোর পর থেকেই খাদ্যপণ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এমন একটি কৌশলগত পণ্য, যেটি সরাসরি বাজারে জিনিসপত্রের দাম ও জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, আগস্টে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, সেপ্টেম্বর মাসে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ, অক্টোবরে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, নভেম্বরে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
যদিও বিবিএসের এই তথ্য অনেকেই মানতে নারাজ। তাদের মতে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই ধারা থেকে নতুন বছরেও মুক্তি মিলছে না—এ রকম পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকার পেছনে পাঁচটি কারণ দেখিয়েছে তারা। সেগুলো হলো—আকস্মিক বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কৃষিজাত ফলন হ্রাস, ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়া, বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি, সার অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, স্থানীয় বাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা।
এডিবি যে পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছে, তার শেষ তিনটির সঙ্গে সরাসরি জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামের যোগসূত্র রয়েছে। কিন্তু বিশ্বে এখন খাদ্যের মূল্য এক বছর আগের দামে ফিরেছে। এফএও-র তথ্য অনুযায়ী গত বছর ডিসেম্বরে রাশিয়া-ইউক্রেনের এক মেট্রিক টন গমের দাম যেখানে ৩৩৬ মার্কিন ডলার ছিল, সেখানে গত ২৫ নভেম্বর গমের দাম ছিল ৩১৫ থেকে ৩২০ ডলার। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, বিশ্ববাজারে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ছাড়া সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম যুদ্ধ–পূর্ববর্তী অবস্থায় পৌঁছেছে।
বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম যুদ্ধ–পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসায় দেশে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে এবং আগামী বছর সেটা অব্যাহত থাকবে বলে এডিবি যে পূর্বার্ভাস দিয়েছে, তার পেছনে বৈশ্বিক কারণের অবদান সামান্যই। সিংহভাগ অবদান দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাজনিত সংকট। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভুল নীতি, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে বড় অনিয়ম, দুর্নীতি ও পাচার—এ সবই এর পেছনে মূল কারণ। সরকারের বেশির ভাগ নীতি ও সিদ্ধান্ত হয় গোষ্ঠীস্বার্থে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সব বোঝাটা চাপিয়ে দেওয়া হয় জনগণের ঘাড়ে।
ইউক্রেন যুদ্ধ অন্য অর্থে বিশ্বজুড়ে জ্বালানির যুদ্ধও। যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যে জ্বালানির দাম এতটাই বেড়ে যায় যে দেশে দেশে বিশাল জনগোষ্ঠী নতুন করে গরিব হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে জ্বালানি-গরিব নামে নতুন একটি পরিভাষারও জন্ম হয়েছে। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন আগস্টে এক লেখায় দেখিয়েছিলেন, জ্বালানি-দারিদ্র্য ব্রিটেনে কীভাবে একটা হীনম্মন্য প্রজন্ম তৈরি করছে। ওই লেখায় ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষার বরাতে তিনি দেখান, এপ্রিলে জ্বালানির ৫৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির ফলে ব্রিটেনের ১ কোটি পরিবারের ২ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে জ্বালানি-দারিদ্র্যের (জ্বালানির উচ্চমূল্যের ফলে সৃষ্ট দারিদ্র্য) ফাঁদে পড়তে হয়েছে। অক্টোবরে নতুন করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি হলে ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবারের ৩ কোটি ৫০ মানুষ জ্বালানি-দারিদ্র্যে পড়বে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির চাপে আমাদের দেশে কত মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট সেই পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু ওএমএসের লাইনে মানুষের দীর্ঘ সারি বলছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে নতুন গরিবের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আগস্টে একধাপে জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ বাড়ানোর পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনার মুখে ৫ টাকা কমিয়েছিল সরকার। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তারা বহুবার বলেছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে সরকার দাম ‘সমন্বয়’ করবে। কিন্তু বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বাজারে জ্বালানির তেলের দাম সমন্বয়ের নির্দিষ্ট কোনো সূত্র এখানে নেই। অভিজ্ঞতা বলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের দাম সমন্বয়ের অর্থ হলো দাম বাড়ানো। এত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) নামমাত্র গণশুনানির মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু এখন সরাসরি সরকার নিজেদের হাতে সেই ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের (ব্রেন্ট ক্রুড) দাম ব্যারেলপ্রতি ১৩৯ ডলারে উঠেছিল। গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৭৮–৮০ ডলারে ওঠানামা করেছে । গত বছরের নভেম্বরে যখন আগের দফায় দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল, সে সময় বিশ্ববাজারে দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮০ ডলারের কাছাকাছি। ফলে এখন বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম গত বছরের নভেম্বরের পর্যায়ে নেমে এসেছে।
সরকারের যুক্তি হলো, বিশ্ববাজার কতটা স্থিতিশীল হলো সেটা দেখে তারা সিদ্ধান্ত নেবে। প্রতিমন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, জ্বালানির দাম সমন্বয়ে কাজ চলছে। কিন্তু বাস্তব কিছু উল্টো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর বিতরণ কোম্পানিগুলোর তরফে ভোক্তা পর্যায়ে বাড়ানোরও তোড়জোড় চলছে। অর্থনীতি বিষয়ক সমন্বয় কাউন্সিলের বৈঠকে গ্যাস–বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। গত মাসে পাইকারি কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে যখন প্রতিনিয়ত মানুষ গরিব হচ্ছে, ওএমএসের লাইনে দাঁড়ানোর জন্য প্রতিযোগিতা করছে, ‘২৫ কেজি চাল পেতে যখন ৫০ জোড়া হাত’ অপেক্ষা করছে সে সময় তেলের দাম এত দিনেও না কমানোর যুক্তিটা কী? মূল্যস্ফীতির বোঝা কমাতে শুধু জ্বালানি তেলের দাম কমানো নয়, সামঞ্জস্য রেখে পরিবহনের ভাড়াও কমাতে হবে। নির্বাহী সিদ্ধান্তে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো–কমানোর পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক