কেমন হবে ভবিষ্যতের বাণিজ্যিক ব্যাংক

ইদানীং বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকের যেমন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা, অন্যদিকে কিছু ব্যাংক, যাদের বেশির ভাগ প্রধান নির্বাহী আন্তর্জাতিক বা বিদেশি ব্যাংক থেকে এসেছেন এবং ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বেশ বিনিয়োগ করেছেন, তাদের অবস্থা বেশ ভালো বলে শোনা যাচ্ছে। দুর্বল ব্যাংক থেকে তাদের কাছে যেমন গ্রাহকের আমানত চলে আসছে, তেমনি তারাও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও স্থিতিপত্রের সুচারু ব্যবস্থাপনায় নিরাপদ ইনস্ট্রুমেন্টে টাকা খাটিয়ে মুনাফার অঙ্ক অনেক বাড়াতে পেরেছে।

বাংলাদেশের বৃহৎ বাণিজ্যিক ব্যাংক দি সিটি ব্যাংক লিমিটেড ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে গেছে ও যাচ্ছে। বাজার ও গ্রাহকের জীবনে আসা পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি ব্যাংকটি বেশ কিছুদিন আগেই অনুধাবন করতে পেরেছে। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইএফসি ব্যাংকটিতে ইকুইটি পার্টনার হওয়ায় এই পরিবর্তনের গতি আরও বেড়েছে। তারা বাণিজ্য ও ঋণ পরিচালনাসংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলোতে জোর দিচ্ছে এবং একই সঙ্গে কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট মডেলে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে।

বৃহৎ করপোরেট অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনা শাখাগুলো থেকে প্রধান কার্যালয়ে সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ব্যাংকটি সংস্কারকাজ শুরু করেছিল। এরই মধ্যে বাণিজ্যিক ও রিটেইল ব্যাংকিং গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টের বিষয়েও একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংকটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা আমাকে জানিয়েছেন, এ পদক্ষেপ সার্বিক গ্রাহক সম্পর্ক ব্যবস্থাপনা অভিজ্ঞতার উন্নতি ঘটিয়েছে, বিশেষ করে বড় গ্রাহকদের ক্ষেত্রে এবং গ্রাহকদের হকচকিত করে এমন বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে গ্রাহকদের আরও ভালো পণ্য সেবা নিশ্চিত করা হবে।

আমরা জানি যে ইস্টার্ণ ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক এবং কিছু ক্ষেত্রে ঢাকা ব্যাংক ও প্রাইম ব্যাংকের মতো কিছু ব্যাংকে এরই মধ্যে ব্যবসা ও প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয়করণ হয়েছে। ব্র্যাক ব্যাংক প্রযুক্তিসহ সামগ্রিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ইতিমধ্যে বেশ বিনিয়োগ করেছে। আরও করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এই ব্যাংকগুলোর সম্মানিত গ্রাহকেরা প্রাথমিকভাবে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হলেও এখন তারা সুবিধা উপভোগ করছে। ভালো কেন্দ্রীয়করণের সঙ্গে সার্বিক সুশাসনের উন্নতি ঘটেছে। একই সঙ্গে সেবার মানও বেড়েছে। বৃহৎ ক্লায়েন্ট গ্রুপের প্রতিটিকে অথবা গ্রাহকদের একটি অংশকে একজন রিলেশনশিপ ম্যানেজারের (আরএম) তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয় এবং ওই আরএম গ্রাহকদের বাণিজ্য, ব্যাংকিং লেনদেন ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, এমনকি প্রয়োজনে তাদের নির্বাহীদের রিটেইল ব্যাংকিং চাহিদা সমন্বয় সাধন করবেন।

আরএমরা গ্রাহকদের আয়-সম্পদ সম্পর্কে আরও ভালো জানতে পারেন এবং এর ফলে ব্যাংকের জন্য আরও ভালো ব্যবসা ও রাজস্ব নিশ্চিত করতে পারেন।

ব্যাংকগুলো এখন বুঝতে পারছে সিসি (ক্যাশ ক্রেডিট) এবং হাইপো (প্ল্যান্ট ও মেশিনারিজের ওপর প্রাধিকার বা চার্জ) বা অঙ্গীকারের (ব্যাংক নিয়ন্ত্রিত গুদাম থেকে পণ্যের অঙ্গীকারের বিপরীতে ঋণ) দিন শেষ। তারা আরও বুঝতে পারছে যে দীর্ঘমেয়াদি আমানত থেকে সরে এসে তাদের রিটেইলে কারেন্ট ও সেভিংস ব্যাংক ডিপোজিটের মাধ্যমে কম ব্যয়বহুল (লো কস্ট) আমানতের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে এবং নজর দিতে হবে ভালো লেনদেন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে করপোরেট ব্যাংকিংয়ে আরও ফ্লোট বা লেনদেন মুনাফা অর্জনের প্রতি। ভালো প্রাপ্য ও প্রদেয় ব্যবস্থাপনা ক্রমেই আরও ভালো পারফরম্যান্স ও আগামী দিনের কথা ভাবা ব্যাংকগুলোর জন্য ‘মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু’ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্কের (বিইএফটিএন) কল্যাণে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। এখন আবার চলে এসেছে ব্যাংকের মাধ্যমে ইনস্যুরেন্স প্রোডাক্ট বিক্রির কথা কিংবা ব্যাংকের আরও অভিনব সেবার কথা।

দেখা যাচ্ছে, স্মার্ট ব্যাংকগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে চোখের নিমেষে এবং এর ফলে তারা তাদের বড় গ্রাহকদের দ্রুত ঋণ দিতে বা সমন্বয় করতে পারছে। অন্যদিকে গ্রাহকেরা তাদের ঋণঝুঁকি (লোন এক্সপোজার) কমাতে পারছে এবং এর ফলে সার্বিক ব্যয়ও কমাতে পারছে।

কেন্দ্রীয়করণের ফলে ব্যাংকের জ্যেষ্ঠরা গ্রাহক ব্যবসা ও ত্রুটির প্রতি বাড়তি নজর দেওয়ার পাশাপাশি আরও ভালো রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারবেন। এ ব্যাংকগুলো যেহেতু ঐতিহ্যগত শাখাভিত্তিক মডেল থেকে সরে আসছে, তাই শাখার কর্মকর্তাদের হাতে এখন বেশি সময় থাকবে এবং তাঁরা এখন গ্রাহকসেবায় আরও বেশি সময় দিতে পারবেন। এ শাখাগুলো সম্পূর্ণরূপে বিক্রয় ও সেবাকেন্দ্র হয়ে উঠছে। নিজেদের গ্রাহকদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শাখার যে আয় হবে, তাতেও তাদের অংশ থাকবে। তাদের বড় গ্রাহকদের সহায়তা দেবে কেন্দ্রীভূত রিলেশনশিপ ম্যানেজার বা ‘আরএম’ টিম। ওপরে উল্লিখিত মানের কারণে গ্রাহকেরাও আরও ভালো পণ্য সহযোগিতা ও সেবা পাচ্ছে।

আমি বলব, শুধু কেন্দ্রীয়করণই উত্তর হতে পারে না। একটি সঠিকভাবে অঙ্কিত ক্রেডিট বা ঋণনীতির প্রয়োজন রয়েছে আমাদের। আমাদের বেশির ভাগ অর্থ কোথায় রাখব? ৫ বা ১০ বা ২৫ বছর পর কোন খাত বেশি করে বিনিয়োগকারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করবে? সময়ের বিবর্তন ও গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কীভাবে প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্টের রূপ পরিবর্তন করা উচিত? বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দ্রুত আমাদের গ্রাহকদের জীবন পরিবর্তন করছে। এদের সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য আমাদের দ্রুত পরিবর্তন আনতে হবে এবং সঠিক পণ্যের পরিকল্পনা করতে হবে।

বলা হয়, ব্যাংকের সুদ ও ফি আয়ের অনুপাত হওয়া উচিত ৫০–৫০। একটি স্মার্ট ব্যাংক সব সময় চেষ্টা করবে সুদের বদলে ফি আয় বৃদ্ধির এবং এভাবে ধীরে ধীরে ব্যালান্স শিট ঝুঁকি এড়াবে। একটি ভালো ব্যাংক সব সময় চেষ্টা করবে করপোরেট পরামর্শ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, কাঠামোবদ্ধ অর্থায়ন বা সিন্ডিকেশন থেকে নিজেদের জন্য বেশির ভাগ অর্থ আয় করতে, যেখানে তারা অন্যদের সঙ্গে দায় শেয়ার করার মাধ্যমে ঝুঁকি কমাতে পারবে। ২০০১ সালে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক হাসপাতাল গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহ করেছিল; কিন্তু কারও নিজ স্বার্থে ব্যবহারের জন্য সে অর্থ ঋণ দেয়নি। ব্যাংকটি শীর্ষ ব্যবস্থাপক হিসেবে সিন্ডিকেটেড অর্থায়নটিকে নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এতে বিনিয়োগ করেছিল।

আমরা ব্যাংকগুলোকে মেয়াদি আমানত বা নিহিত সম্পদ অচল করার কথা বলছি না। একটা পর্যায় পর্যন্ত এটা রাখা যেতে পারে। তবে তাদের নজর সব সময় থাকা উচিত আরও ভালো রিস্ক বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মুনাফা বাড়ানোর প্রতি। বৃহদংশ ম্যাচিং ডিপোজিট ছাড়া নির্দিষ্ট সুদহারে মেয়াদি ঋণগুলো বিপজ্জনক হতে পারে। অন্যদিকে মেয়াদি আমানতের জন্য সুদহার নিয়ে অতিরিক্ত ইঁদুরদৌড় ব্যাংকগুলোকে তাদের পরিষেবা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে সহায়তা করবে না। পক্ষান্তরে কেউ যদি আন্তব্যাংক বা বাজার আমানতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে থাকে, তবে সুদহারে যেকোনো অস্থিরতা তাদের বাজেভাবে বিপদগ্রস্ত করতে পারে।

আমার ট্রেজারির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ক্লড লোবো বলতেন, পরিবর্তন হলো জীবনের সবচেয়ে নিশ্চিত বিষয়। যখন পুরো বিশ্ব পরিবর্তন হচ্ছে, তখন তুমি যদি না হও, তবে প্রকৃতপক্ষে তুমি পেছনে হাঁটছ। কে জানে, আজকের বড় ব্যাংকগুলো হয়তো আগামী দিনে না-ও থাকতে পারে, যদি না তারা আমরা যেভাবে ব্যবসা করি বা বড় ব্যবসাগুলোতে যে পরিবর্তন আসবে, তার সঙ্গে যথেষ্ট গতিতে পরিবর্তন না আনতে পারে। ‘আমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের সেবা দিয়েছি’—এ কথা আগামী প্রজন্মের কাছে টিকবে না। আগামী প্রজন্ম স্বল্পতম সময়ে সরবরাহযোগ্য, আন্তর্জাতিক বাজারে পরীক্ষিত স্বল্পতর মূল্যের আরও ভালো পণ্যের দাবি করবে।

কেমন হবে একটি ভবিষ্যতের বাণিজ্যিক ব্যাংক? এটি কি শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মেয়াদি আমানত নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে? শুধু পোশাকশিল্পের ঋণপত্র খোলা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে? গ্রাহক কি শুধু মেয়াদি ঋণ নিতেই ব্যাংকে আসবে, নাকি চলে যাবে পুঁজিবাজারে? ব্যক্তি ধনীদের জন্য ব্যাংকের পণ্য সেবা কী হবে? কে হবেন অধিকতর প্রযুক্তিনির্ভর সেই ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী? তিনি কি আসবেন কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে, নাকি একটি ‘ফিনটেক’ কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কিংবা চিফ টেকনোলজি অফিসার (সিটিও) হবেন আধুনিক এই ব্যাংকের প্রধান কর্মকর্তা? আমি যে ওপরে কিছু ভালো ব্যাংকের উদাহরণ টানলাম, তাদের সবই কি ৫০ বা ৭৫ বছর পর টিকে থাকবে? এসব প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় আছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।

  • মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক