এবার যে এপ্রিল মাস পার করল বাংলাদেশ, তা যেন শত বছর আগে টি এস এলিয়টের উচ্চারণকে আরও একবার আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করে তুলল। ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতায় কবি এপ্রিলকে ‘নিষ্ঠুরতম’ অভিহিত করছিলেন—‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’।
কবিতাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে ধ্বংসযজ্ঞ ও নিরাশার প্রেক্ষাপটে রচিত। ফলে এর বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্ন কাব্যরূপ আসলে প্রথম ওই সময়ের ভাঙন ধরা, অর্থহীনতায় সওয়ার সময়ের ছবি। আর গত উষ্ণতম এপ্রিলকে সম্ভাব্য ভয়াবহ আগামী দিনের আগাম সতর্কবার্তা হিসেবেই দেখা অধিক সংগত।
শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বই ইতিহাসে এবার সবচেয়ে উষ্ণতম এপ্রিলের সাক্ষী হলো। এর কারণ কমবেশি প্রায় সবারই জানা; মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের জন্যই বৈশ্বিক জলবায়ু আজ এতটা লাগামছুট। তবে মো. সুজন মিয়ার মতো কিছু মানুষ না শুনেছেন এলিয়টের নাম, না পড়েছেন কবিতা, না জানেন ধরিত্রীর আজকের এই চরম দুর্দশার পেছনে পুঁজির পেছনে অন্ধ ছোটাছুটি আর মুনাফার জন্য রুদ্ধশ্বাস দৌড়ঝাঁপের কাহিনি।
অক্ষরজ্ঞান নেই বলেই যে এসব থেকে দূরে সুজন মিয়া, তা অবশ্য বলা যাবে না। কেননা, মাসের একটা দিনও কাজে বিরতি দেওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না তাঁর। ফলে টেলিভিশনের খবর দেখে-শুনেও হালনাগাদ থাকার ফুরসত হয় না তাঁর। পেটেভাতে জীবনে তাঁর প্রতিদিন হালনাগাদ রাখতে হয় শুধু ‘রোজগার’। তাই খুব প্রয়োজন না থাকলে ঘরের বাইরে বের না হওয়াসহ নানা সতর্কতামূলক পরামর্শ সুজনের কাছে জানা কিংবা না-জানা—দুই-ই সমান কথা।
বৃষ্টিশূন্য এপ্রিলের তাপপ্রবাহের দিনগুলোর প্রতিটি দিনই তাঁকে কাজে বের হতে হয়েছে। তেমনি বিরামহীন বৃষ্টির সময়েও তাঁর দিনগুলো রোজাগারে বাঁধা। সুজন জানালেন, দু-আড়াই মাসে হয়তো এক দিন মালামাল কেনা হয় না। তা-ও যেদিন দামে পড়তায় হয় না, সেদিন। যেহেতু তিনি সড়কের পাশে বসে বেল বেচেন, তাই তাঁর কাছ থেকে লোকে একটু দাম বেশি হলেই নিতে চান না। ঢাকাবাসের ৯ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এটা শিখেছেন।
অবশ্য সুজন একা নন, তাঁর স্ত্রীরও কাজ কামাই দেওয়া কঠিন। দুজনই সকাল ছয়টা নাগাদ ঢাকার পূর্ব রামপুরার ভাড়া বাসা থেকে বের হন। সুজন চলে যান পুরান ঢাকার বাদামতলী অথবা কারওয়ান বাজার। আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার বেল কেনেন, শীতের সময় কেনেন পেঁপে। এরপর চলে যান পশ্চিম রামপুরার উলন রোড অথবা ওয়াপদা রোডে। মূলত এই দুই সড়কের পাশে মাল বেচা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকেন। সাধারণত সন্ধ্যার মধ্যে বেচাবিক্রি শেষ হয়। তবে কখনো কখনো রাত ১০টা থেকে ১১টাও বেজে যায়। দিন শেষে লাভ থাকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
সুজনের হাতে ‘আলাদিনের প্রদীপ’ নেই। তাই বলে মনে খেদও নেই কোনো। রাষ্ট্রের দায় ও নিদায়—কোনোটা নিয়েই ভাবেন না, তাঁর ভাবনায় থাকে শুধু ‘দিন’। বছরের ৩৬৫ দিনের একটাকেও আলাদা করতে পারেন সুজন। সব দিনই তাঁর কাছে ‘নিষ্ঠুরতম এপ্রিল’–এর দিনগুলোর মতো।
অন্যদিকে সুজনের স্ত্রী পরপর কয়েকটা বাসায় কাজ করেন। তাঁর পোশাকি পরিচয় গৃহকর্মী, ঢাকাইয়া ভাষায় যাকে বলা হয় ‘বুয়া’। তিনি ঘরে ফেরেন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। দুজন মিলে মাস শেষে যা রোজগার করেন, তার খাতওয়ারি ভাগ শেষে হাতে থাকে ‘শূন্য’ টাকা।
মেয়ের বয়স ১৪, সে একটি মাদ্রাসায় পড়ে। ৮ বছরের ছেলেকেও গত বছর থেকে মাদ্রাসায় দিয়েছেন। দুই সন্তানের বেতন মাসে পাঁচ হাজার টাকা (ছাড় পাওয়ার পর)। দুই কামরার বাসার ভাড়া ৫ হাজার ২০০ টাকা। খাওয়াদাওয়া, পোশাক-আশাক, ওষুধপথ্য ইত্যাদির খরচ আছে। কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে গ্রামে মাকে টাকা পাঠাতে হয়। মায়ের সঙ্গে থাকে বোনের সাত বছরের এক মেয়ে। বোনটি মারা গেছেন।
পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন সুজন। এরপর কেটে গেছে সাড়ে তিন দশক। কৈশোর থেকে মাঠের কাজ করতেন। কিন্তু এতে পেরে উঠছিলেন না, পরে স্বামী-স্ত্রী মিলে গায়েগতরে খেটে একটু বাড়তি রোজগারের আশায় ঢাকায় আসা। গ্রামে নিজেদের একটু ভিটেও নেই। সুজন বলছিলেন, তাঁর মা ও খালা মিলে নানার মাত্র দেড় শতক জায়গা পেয়েছেন। খালা এখনো তাঁর হিস্যা বুঝে নেননি। সেই জায়গাতেই একটা ঘর তুলে মা থাকেন।
তবে একটু স্বস্তি পান খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় মা ১৫ টাকা কেজি দরে (আগে ছিল ১০ টাকা কেজি) মাসে ৩০ কেজি চাল পান, এতে। যদিও সুজনের দাবি, ১৫ টাকা দরে ৩০ কেজি চাল পেতে ৪৫০ টাকা লাগার কথা থাকলেও দিতে হয় ৫০০ টাকা। মা ও ভাগনির মাসে পুরো চাল লাগে না। সুজন বাড়ি গেলে বাড়তি চাল নিয়ে আসেন ঢাকায়। মায়ের জন্য অন্যান্য সদাইপাতি করে দিয়ে আসেন।
সুজনের হাতে ‘আলাদিনের প্রদীপ’ নেই। তাই বলে মনে খেদও নেই কোনো। রাষ্ট্রের দায় ও নিদায়—কোনোটা নিয়েই ভাবেন না, তাঁর ভাবনায় থাকে শুধু ‘দিন’। বছরের ৩৬৫ দিনের একটাকেও আলাদা করতে পারেন না সুজন। সব দিনই তাঁর কাছে ‘নিষ্ঠুরতম এপ্রিল’–এর দিনগুলোর মতো।
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]