ট্রাম্পের দায়মুক্তি রায়: আইন কি আইন ভাঙার জন্য

ডোনাল্ড ট্রাম্প

‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ (মাগা) শীর্ষক চিরন্তন যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়া সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য গত সোমবার দিনটি বড় আনন্দের দিন ছিল। 

ট্রাম্প হলেন প্রথম কোনো সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান, যাঁর নামে দায়ের করা ফৌজদারি মামলায় বিচার চলছে এবং একটি অপরাধের জন্য তিনি দোষী সাব্যস্তও হয়েছেন।

২০২০ সালের নির্বাচনী ফল উল্টে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করার মামলায় ২০২৩ সালে একটি ফেডারেল গ্র্যান্ড জুরি ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করেছিল।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট (যেখানে ট্রাম্পপন্থী রক্ষণশীল বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে) রায় দিয়েছেন, প্রেসিডেন্টরা মূলত আইনের ঊর্ধ্বে, তাই ট্রাম্প দায়মুক্তি পাবেন। আমেরিকার গত ২৪৮ বছরের ইতিহাসে এই রায় নজিরবিহীন।

রায়ে বলা হয়েছে, ‘আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোর অধীনে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার যে প্রকৃতি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা একজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে তাঁর সাংবিধানিক এখতিয়ারভুক্ত কাজের জন্য ফৌজদারি বিচার থেকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তির অধিকারী করেছে।’ 

আরও পড়ুন

রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট ‘তাঁর সব দাপ্তরিক (অফিশিয়াল) কাজের জন্য বিচার থেকে দায়মুক্তির অধিকারী’ তবে ‘অ-দাপ্তরিক (আন অফিশিয়াল) কাজের ক্ষেত্রে তাঁর জন্য কোনো দায়মুক্তি থাকবে না।’ 

এখন প্রশ্ন হলো, প্রেসিডেন্টের কোন কাজটি ‘অফিশিয়াল’ আর কোন কাজটি ‘আন–অফিশিয়াল’, সেটি পার্থক্য করার চিহ্নরেখা কে টানবে? 

দেখা যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্ট নিজেও সেই পার্থক্য টানা রেখাটি সম্পর্কে সত্যিই কিছু জানে না। রায়ের একটি জায়গায় আমরা একটি ব্যাখ্যার মতো দৃশ্যমান কিছু কথা পাই।

যেমন রায়ের কয়েক পৃষ্ঠা নিচের দিকে বলা হয়েছে, ‘প্রেসিডেন্ট যখন “সাংবিধানিক এবং বিধিবদ্ধ কর্তৃত্ব” অনুসারে কাজ করেন, তখন আসলে তিনি তাঁর অফিসের কাজ সম্পাদনের জন্য সরকারি পদক্ষেপই নেন।’

এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু তারপর কিছু বিভ্রান্তি দেখা দেয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও আইনের অধীনে প্রেসিডেন্টের ‘বিবেচনাপ্রসূত দায়িত্বগুলোর’ ব্যাপকতা প্রায়ই তাঁর কোন কাজটি দাপ্তরিক ও কোনটি দাপ্তরিক কাজের বাইরে, তা নির্ধারণ করা কঠিন করে তোলে।

আরও পড়ুন

যেহেতু প্রেসিডেন্ট হলেন সর্বময় ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট, সেহেতু তাঁর যেকোনো কাজ কোনো না কোনো বিবেচনায় সরকারি কাজ হিসেবে বোঝানো যেতে পারে। 

রায়ের উপসংহারে বলা হয়েছে, আদালত যে দায়মুক্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তা প্রেসিডেন্টের দাপ্তরিক দায়িত্বের ‘বাইরের পরিসর’ পর্যন্ত প্রসারিত।

অর্থাৎ যে কাজগুলো প্রকাশ্যভাবে বা স্পষ্টতই প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বের বাইরের কাজ নয় বলে প্রতীয়মান, সে কাজকে দায়মুক্তির আওতাধীন বলে ধরা যেতে পারে। 

সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের মাধ্যমে এই সহজ আশ্বাস দিচ্ছেন যে ‘রাজনীতি, নীতি বা দল নির্বিশেষে ওভাল অফিসের সব দখলদারদের জন্য দায়মুক্তি সমানভাবে প্রযোজ্য।’ 

এই রায়ের ব্যাপারে যে তিনজন বিচারপতি ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন সোনিয়া সোটোমায়র। রায়টির প্রভাব এবং এর বিপজ্জনক দিক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এটি ভবিষ্যতের যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বেপরোয়া করে তুলতে পারে।

আরও পড়ুন

প্রেসিডেন্ট যদি তাঁর কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করার জন্য নৌবাহিনীর সিল টিম ৬-কে আদেশ দেন? তাঁর চিন্তা থাকবে না। কারণ, তাঁর জন্য দায়মুক্তি থাকবে। কোনো প্রেসিডেন্ট যদি ক্ষমতা ধরে রাখতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান? অসুবিধা নেই।

কারণ, দায়মুক্তি তো থাকছেই। কাউকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার বিনিময়ে যদি প্রেসিডেন্ট ঘুষ খান? তাতেও অসুবিধা নেই। দায়মুক্তি তো থাকছেই। 

যে বিচারপতিরা দায়মুক্তির এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাঁদের তিনজনকে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় নিয়োগ দিয়ে এসেছিলেন। ফলে এই সিদ্ধান্তকে ট্রাম্প নিজেই সম্ভব করেছেন বলে মনে করা যেতে পারে।

রায়ের পর তাৎক্ষণিকভাবে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সংবিধান এবং গণতন্ত্রের জন্য বড় জয়। একজন আমেরিকান হতে পেরে আমি গর্বিত।’ 

এটি অবশ্যই ঠিক, একটি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং বর্ণবাদী ধনতান্ত্রিক সমাজে, যেখানে অভিজাত অন্যায়-অত্যাচার ও কালোটাকার প্রভাব খাটানো একটি সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা সমর্থিত হয় এবং মৌলিক অধিকারগুলোকে ঠান্ডা মাথায় নষ্ট করে ফেলা হয়, সেখানে মৌলিকভাবে গণতান্ত্রিক কিছু থাকতে পারে না। 

আজ পর্যন্ত কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালানোর জন্য বা আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘনের জন্য দায়ী করা হয়নি। এখন সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে মনে হচ্ছে, আসলেই আইন বানানো হয় আইন ভাঙার জন্য। 

কিন্তু, আরে! এগুলোই তো দেখছি এখন আমেরিকাকে ‘মহান’ করে তুলছে! যাহোক, মার্কিন প্রেসিডেন্টরা দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে থেকে আসছেন। এখন থেকে তাঁদের নিজেদের দেশের ভেতরকার আইনেরও ঊর্ধ্বে থাকা উচিত; তাই না? 

আজ পর্যন্ত কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা চালানোর জন্য বা আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘনের জন্য দায়ী করা হয়নি। এখন সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে মনে হচ্ছে, আসলেই আইন বানানো হয় আইন ভাঙার জন্য। 

বেলেন ফার্নান্দেজ আল–জাজিরার নিয়মিত কলাম লেখক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত