বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্যাপনের জন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন। মনে পড়ছে, বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর হয়েছিল ১৯৯৪ সালে, তখন তাদের উদ্যাপনের পাশাপাশি বিশ্বের বহু দেশে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গণ-আদালত গঠিত হয়েছিল।
সবচেয়ে বড় গণ-আদালত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নেতৃত্বে। আশির দশকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ পরিচালিত কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি বা স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রামের বিষফল তখন ক্রমে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে বিশ্বব্যাংকও তখন কিছু পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়। সেগুলোর ফলাফল তাদের অনুকূলে যায়নি।
‘বিদেশি সাহায্য’, ‘টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স’, ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’, ‘রুটিন অ্যাডভাইজ’ ইত্যাদি একেকটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি কীভাবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সাধারণ সম্পত্তি দেশি-বিদেশি ব্যক্তিমালিকানায় নিয়ে যায়, অন্ধ প্রবৃদ্ধির বদলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভাবনা বিপর্যস্ত করে এবং সর্বজনের অধিকার মুনাফামুখী তৎপরতার অধীন করে, তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ এই দেশের জ্বালানি, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, বন্দর, রেলওয়ে, পানি ইত্যাদি খাত। এসব অভিজ্ঞতার কারণে ২০০৭ সালে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক ও তাদের সহযোগী আইএমএফ ও এডিবির কার্যক্রম নিয়ে গণট্রাইব্যুনালের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সে বছর ৩ নভেম্বর বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এর ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন লেখক ফয়েজ আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে এম সাদউদ্দীন, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, অধ্যাপক এম এম আকাশ। সংহতি জানিয়ে বার্তা পাঠান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ও টিআইবির তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক মুজফফর আহমদ।
সেখানে আমি যে ঘোষণা পাঠ করি, তাতে বলা হয়, ‘...এসব সংস্থার নীতিমালা গ্রহণ করে বাংলাদেশের তেল-গ্যাসক্ষেত্রগুলো এখন বিদেশি কোম্পানির দখলে, নিজেদের গ্যাস বহুগুণ বেশি দামে আমাদের কিনতে হচ্ছে, দেশীয় সংস্থা পঙ্গু; জীবন-জীবিকা-কৃষি-পানি ধ্বংস করে কয়লাসম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার অপচেষ্টায় এসব সংস্থা এখনো সক্রিয়; সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প দিয়ে বহু অঞ্চল এখন জলাবদ্ধতার শিকার...পাট খাত উন্নয়নের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পাটশিল্প বিপর্যস্ত; শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে নানা প্রকল্পের প্রভাবে এই খাতগুলো ছিন্নভিন্ন এবং ক্রমে জনগণের প্রবেশাধিকার সংকুচিত; সামষ্টিক অর্থনীতির নানা কর্মসূচির কারণে অর্থনীতি ক্রমান্বয়ে আমদানিমুখী...।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে জিডিপি বহুগুণ বেড়েছে, কিন্তু এসব প্রকল্পের মধ্য দিয়ে মানুষের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত হয়নি। এই প্রক্রিয়ায় চোরাই কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে, আবার ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার, নিরাপত্তার সুযোগ বিবেচনায় বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই এখনো মানুষের জীবন লাভে সমর্থ হয়নি। অন্যদিকে শতকরা ১ ভাগ দুর্বৃত্তের নিয়ন্ত্রণে ও আধিপত্যে এই দেশ জর্জরিত।’
গণ–আদালতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল, সেগুলোর ফয়সালা এখনো হয়নি। এর পরের দেড় দশকে তাদের কার্যক্রম একই ধারায় অব্যাহত আছে। এরা বরাবর জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার কথা বলে কিন্তু তাদের কাজে এই দুটির অভাবই সবচেয়ে প্রকট। আমাদের জীবন, প্রাণ-প্রকৃতি, সম্পদ, শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্বালানি, বিদ্যুৎ—সবকিছু নিয়ে যারা নানাভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করে, এসবের পরিণতির জন্য তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকবে না কেন? অপরাধের, ক্ষয়ক্ষতির, বিপর্যয়ের বিচার হবে না কেন?
এক বছরের বেশি সময় বিভিন্ন খাতের ওপর অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা শেষে ২০০৮ সালের ১ ডিসেম্বর মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানীর নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনাল বসে। এর অন্য সদস্যরা ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ আবুল মকসুদ, সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক আকমল হোসেন ও কামাল লোহানী। এই ট্রাইব্যুনালের সামনে কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পাট, ব্যাংক, জাতীয় সক্ষমতা ও জ্বালানি খাত নিয়ে তথ্য, যুক্তিসহ বিভিন্ন গবেষক দলের পক্ষ থেকে বক্তব্য উপস্থিত করেন ডা. মুশতাক হোসেন, এম এম আকাশ, শাহ আলম, বজলুর রশিদ ফিরোজ, ড. মঈনুল ইসলাম এবং আমি।
এর আগে ২৩ নভেম্বর, ২০০৮ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি গণট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইএমএফ ঢাকা অফিসের রেসিডেন্স রিপ্রেজেনটেটিভ ও এডিবি ঢাকা অফিসের কান্ট্রি ডিরেক্টরকে এই মর্মে নোটিশ দেওয়া হয়, ‘গণট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে, তাতে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তাঁরা বা তাঁদের প্রতিনিধিরা যেন উপস্থিত থাকেন। অন্যথায় একতরফা শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।’ তাঁরা কেউ উপস্থিত হননি।
ট্রাইব্যুনালের সামনে এই সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ সুনির্দিষ্ট করা হয়েছিল নিম্নরূপে:
১. প্রতারণা। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের কথা বলে বিভিন্ন প্রকল্প মহিমান্বিত করে কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য প্রমাণিত হয় অর্থনীতির ওপর বিশ্ব পুঁজির দখল নিশ্চিত করা...।
২. অস্বচ্ছতা, গোপনীয়তা।...এসব সংস্থা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির কথা ক্রমাগত বললেও নিজেদের প্রকল্প কিংবা জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাতসহ নানা ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত চুক্তি ও সমঝোতা গোপন রাখার পক্ষে অবস্থান নেয়।
৩. ঘুষ ও দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা। এসব প্রকল্প ও চুক্তির পক্ষে সরকারকে প্রভাবিত করার জন্য আমলা, মন্ত্রী, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের বিদেশ সফর, কনসালট্যান্সি, অবসর-পরবর্তী উচ্চ বেতনে চাকরি ইত্যাদি বন্দোবস্ত রেখে ঘুষ ও দুর্নীতির নতুন এক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়...।
৪. চাপ, হস্তক্ষেপ ও লবিং। সব সাধারণ সম্পত্তি মুনাফামুখী তৎপরতায় দিয়ে দেওয়া এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি, পরিবেশদূষণ, খাদ্য ও জ্বালানিনিরাপত্তা বিনষ্ট করার মতো প্রকল্প গ্রহণের জন্য এসব সংস্থা হস্তক্ষেপ, ব্ল্যাকমেল, চাপ ও লবিংয়ের নানা পথ অবলম্বন করে। চিংড়িঘের, বন, পানি প্রকল্প, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ, পিএসআই চুক্তি ও ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাস্তবায়নের অপচেষ্টা, তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিতে স্থবিরতা তৈরি এসবের কিছু দৃষ্টান্ত...।
৫. জাতীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বল, পঙ্গু বা বিলুপ্তকরণের মাধ্যমে জাতীয় সক্ষমতার বিনাশ। আদমজী পাটকল, চট্টগ্রাম স্টিল মিল, রেলওয়ে, পাবলিক হাসপাতাল, বিএডিসি, পিডিবি, পেট্রোবাংলা, বাপেক্স, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, চট্টগ্রাম বন্দর ইত্যাদির দুর্বলতা বা বিলুপ্তি এসব সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের ফলাফল।
৬. সংকটের অজুহাতে অধিকতর সংকট সৃষ্টি। বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা এবং সেই অজুহাতে সেসব সংস্থা বন্ধ করা বা বেসরকারীকরণ এদের বিভিন্ন প্রকল্পের লক্ষ্য হিসেবে প্রমাণিত...।
৭. জাতীয় অর্থনীতির পরিমাপযোগ্য ও অপরিমাপযোগ্য বিপুল ক্ষতিসাধন। এসব সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি খাতে বিপুল ব্যয়বৃদ্ধি, কৃষি ও শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে উৎপাদনশীলতা এবং কর্মসংস্থান হ্রাস, পরিবেশদূষণ, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস, জাতীয় উদ্যোগ বিনষ্টকরণ, মেধা পাচার, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদিতে জনগণের প্রবেশাধিকার সংকোচন ও ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ অপরিমেয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। যুক্তিযুক্ত বেতন ও ন্যূনতম মজুরির বিরোধিতা করে জনগণের উৎপাদনশীলতা হ্রাস ও জীবন দুর্বিষহ করাতেও তাদের ভূমিকা প্রধান।
৮. অপরাধ করেও আইনের আওতামুক্ত থাকার অপচেষ্টা। বাংলাদেশের সম্পদ ও সম্ভাবনার বিপর্যয় সৃষ্টিতে সরকার ও সমর্থকদের সহযোগে এই সংস্থাগুলো প্রত্যক্ষভাবে দায়ী; তারা যে তাদের অপরাধ সম্পর্কে সচেতন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘দায়মুক্তি’ বা ইমিউনিটির জন্য বিশ্বব্যাংকের অব্যাহত অপচেষ্টায়...।
এক বছরের বেশি সময় অনুসন্ধান এবং তার ওপর কয়েক ঘণ্টা শুনানির পর ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, ‘...এই ট্রাইব্যুনাল মনে করে যে এসব ধ্বংসাত্মক নীতি, প্রকল্প ও বেআইনি কার্যকলাপের ফলে বাংলাদেশের ব্যাপক আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল এসব ক্ষতি ও অপরাধের জন্য বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগীদের সম্মিলিতভাবে দোষী সাব্যস্ত করছে।...একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির দ্বারা এই বিশাল অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির সুষ্ঠু পরিমাপ করতে হবে এবং বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগীদের কাছ থেকে এসবের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে...।’
গণ–আদালতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এডিবির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল, সেগুলোর ফয়সালা এখনো হয়নি। এর পরের দেড় দশকে তাদের কার্যক্রম একই ধারায় অব্যাহত আছে। এরা বরাবর জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার কথা বলে কিন্তু তাদের কাজে এই দুটির অভাবই সবচেয়ে প্রকট। আমাদের জীবন, প্রাণ-প্রকৃতি, সম্পদ, শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্বালানি, বিদ্যুৎ—সবকিছু নিয়ে যারা নানাভাবে নীতিমালা প্রণয়ন করে, এসবের পরিণতির জন্য তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকবে না কেন? অপরাধের, ক্ষয়ক্ষতির, বিপর্যয়ের বিচার হবে না কেন?
আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক