গত জুনের মাঝামাঝিতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আমন্ত্রণে আঙ্কারা গিয়েছিলেন। তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় স্বাগত জানানোর পর তাঁর ওই সফরকে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘নতুন যুগের’ সূচনা বলে অভিহিত করেছিলেন এরদোয়ান।
২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে ভিন্নমতাবলম্বী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাসংক্রান্ত তথ্য তুরস্কের সরকারি সূত্র থেকে ফাঁস হয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলছিল। মোহাম্মাদ বিন সালমানের তুরস্ক সফরকে সেই উত্তেজনার আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
২০২২ সালের এপ্রিলে তুরস্কের আদালত খাসোগি হত্যা মামলাটির বিচারপ্রক্রিয়া রিয়াদে স্থানান্তর করেন। এর মধ্য দিয়ে সৌদির সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তুরস্কের আদালতের ওই আদেশের পরের মাসেই এরদোয়ান সৌদি সফর করেছিলেন। তবে সৌদি আরব ও তার মিত্রদের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, ততই মুসলিম ব্রাদারহুড ও তার শাখা–প্রশাখা সংগঠনের সঙ্গে এরদোয়ানের দূরত্ব বাড়ছে।
এক দশক আগে আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর গোটা আরব জুড়ে সক্রিয় থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডকে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসেবে দেখে আসছে।
আরব বসন্তের পর এক দশকের বেশি সময় ধরে মুসলিম ব্রাদারহুড মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছে। এই সময় গোষ্ঠীটি নানা ধরনের উপদলে বিভক্ত হয়েছে। এখন তারা অস্তিত্বসংকটে রয়েছে এবং তরুণ মুসলমানদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা আরব বিশ্বে শিগগির আগের মতো শক্তি পাবে না। অনেকের মত হলো, এই গোষ্ঠীকে টিকে থাকতে হলে আগের চেয়ে কম কট্টর ও বেশি উদার হতে হবে।
২০১১ ও ২০১২ সালে মিসরের নির্বাচনে যেভাবে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাফল্য এসেছিল, ঠিক একইভাবে গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৌদিতে সরকার বদলে যেতে পারে এবং সেখানে একজন সুন্নি নেতা প্রতিস্থাপিত হতে পারেন বলে সে সময় এরদোয়ানের মতো নেতারা আশাও করেছিলেন। ওই সময়টি তুরস্ক মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্য এই অঞ্চলে একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।
সেই দিক থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর থেকে আঙ্কারার সমর্থন সরিয়ে নেওয়াকে সৌদি আরব, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য সবচেয়ে আনন্দের খবর হিসেবে দেখা হচ্ছে। এরদোয়ান একদিকে ধীরে ধীরে সৌদি, আরব আমিরাত ও মিসরের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছেন। অন্যদিকে ব্রাদারহুডের আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে আনছেন।
তুরস্ক থেকে সম্প্রচার করা মুসলিম ব্রাদারহুডের টিভি চ্যানেলগুলোকে ইতিমধ্যে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে নিয়ে সমালোচনা না করতে সরকারের দিক থেকে বলে দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সেই ঘরানার একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এ কথা সবাই জানে, মিসরের ক্ষমতাসীন সিসি সরকারের হাত থেকে বাঁচতে সেখানকার মুসলিম ব্রাদারহুডের অনেক নেতা তুরস্ক এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাঁদের মেয়াদ বাড়াচ্ছে না তুরস্ক সরকার। তাঁদের তুরস্ক ছাড়তে উৎসাহিত করতেই এমনটি করা হচ্ছে। এমনকি মিসরের প্রেসিডেন্ট মুসলিম ব্রাদারহুডের যেসব নেতাকে গ্রেপ্তার করে মিসরের হাতে তুলে দিতে অনুরোধ করেছেন, এরদোয়ান সেই অনুরোধও বিবেচনার কথা ভাবছেন।
এ ছাড়া এরদোয়ানের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিতে মুসলিম ব্রাদারহুড ভাবধারার যেসব সদস্য আছেন, তাঁদের দল থেকে বাদ দেওয়ার কথাও তিনি ভাবছেন। এরদোয়ানের এসব তৎপরতা আঙ্কারা ও রিয়াদের সম্পর্কোন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও মুসলিম ব্রাদারহুডের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে।
আরব বসন্তের পর এক দশকের বেশি সময় ধরে মুসলিম ব্রাদারহুড মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছে। এই সময় গোষ্ঠীটি নানা ধরনের উপদলে বিভক্ত হয়েছে। এখন তারা অস্তিত্বসংকটে রয়েছে এবং তরুণ মুসলমানদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে তারা আরব বিশ্বে শিগগির আগের মতো শক্তি পাবে না। অনেকের মত হলো, এই গোষ্ঠীকে টিকে থাকতে হলে আগের চেয়ে কম কট্টর ও বেশি উদার হতে হবে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবিলা করতে এবং সমাজে শরিয়াহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করতে ১৯২৮ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড গঠিত হয়েছিল। এটি শেষ পর্যন্ত সর্বাধিক প্রভাবশালী প্যান-আরব ইসলামিস্ট সংগঠনে পরিণত হয়। এটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। তবে পশ্চিমা সংস্কৃতি ও আধুনিক জীবনধারাবিরোধী হিংসাত্মক মতাদর্শীদেরও তারা অনুপ্রাণিত করেছিল।
২০১১ সালে মিসরে এই ইসলামপন্থী গোষ্ঠীটি শক্ত ভিত গড়ে তোলে এবং তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। একপর্যায়ে তারা মিসরে নিজেদের প্রেসিডেন্টকে গদিতে বসাতে সক্ষম হয়।
তিউনিসিয়ায় মুসলিম ব্রাদারহুড দ্বারা অনুপ্রাণিত রাজনৈতিক দল এন্নাহদা জোট সরকারের শরিক ছিল। তবে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকাসহ নানা কারণে উভয় দেশেই এই ধারার ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা থেকে ছিটকে গেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে তাঁরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেননি।
মিসরে তারা খুব কম সময় ক্ষমতায় ছিল। ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ মুরসিকে উৎখাত করেন এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ভাষ্যমতে, ওই বছরের ১৪ আগস্ট সেনাবাহিনী কমপক্ষে ৮০০ মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী আন্দোলনকর্মীকে হত্যা করেছিল। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে জেলে পোরা হয়। অসংখ্য নেতা-কর্মী জীবন বাঁচাতে তুরস্ক, কাতার ও যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান।
আয়াশ আবদেল রহমান তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া তেমনই একজন মিসরীয় নাগরিক। ছয় বছর ধরে তিনি ইস্তাম্বুলে আছেন। গত বছরের অক্টোবরে তাঁর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তুরস্ক তাকে নতুন করে ভিসা দেয়নি। ফলে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
আয়াশ মনে করেন, এরদোয়ানের মতো লোকেরা যদি মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গ ত্যাগ করে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামি মূল্যবোধ আরেক দফা আক্রান্ত হবে।
ফরেন পলিসি থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত
● আঁচল ভড়ফরেন পলিসির ব্রাসেলসভিত্তিক কলাম লেখক