নাজাত মানে মুক্তি, মুক্তি পাওয়া, মুক্তি দেওয়া, মুক্ত হওয়া ও মুক্ত করা। রমজানের নাজাতের অর্থ হলো এই মাসে মানুষ পাপ–পঙ্কিলতা, গুনাহ ও আবিলতা থেকে মুক্ত হবে, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে; পাপের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হবে। গাইরুল্লাহর মহব্বত থেকে মুক্ত হবে, দুনিয়ার মহব্বত থেকে মুক্ত হবে। আল্লাহর আজাব ও গজব থেকে মুক্ত হবে, আসমানি–জমিনি ও রুহানি–জিসমানি (আত্মিক–শারীরিক) রোগ–শোক, জরা–ব্যাধি থেকে মুক্ত হবে।
নবী–রাসুলগণ মাছুম বা নিষ্পাপ হওয়ার কারণে তাঁরা শয়তানি কুমন্ত্রণা ও রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া যেসব মুমিন মুসলিম শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত থাকার সৌভাগ্য লাভ করেন, তাদের মাদারজাদ (আজন্ম) ওলি বলা হয়। সব মানুষের সঙ্গে শয়তান নিয়োজিত আছে, (সুরা-৫০ কফ, আয়াত: ২৭)। আর জীবনে–মরণে ও ইহকালে–পরকালে একাত্ম সঙ্গী হিসেবে নফস রয়েছে। নফস হলো ষড়্রিপু, তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য।
পবিত্র মাহে রমজানে জিন শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু মানুষ শয়তান ও নফস শয়তান তখনো সক্রিয় থাকে। তাই মানুষ পাপাচার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে না। পাপতাপ থেকে পরিপূর্ণভাবে মুক্তির জন্য প্রথমে ষড়্রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত হয়ে নফস শয়তানকে পরাভূত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মনুষ্য শয়তানের প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য অসৎসঙ্গ ত্যাগ করে সৎসঙ্গ অর্জন করতে হবে। এই দুটি সুসম্পন্ন হলেই পরিপূর্ণরূপে শয়তানের প্রভাব থেকে আত্মরক্ষা করা যাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আর সত্যবাদীগণের সঙ্গী হও।’ (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ১১৯)।
নাফস তথা রিপুর সমন্বয়ে গঠিত মানবসত্তার তিন অবস্থা—যথা নাফসে আম্মারা, নাফসে লাউওয়ামা; নাফসে মুতমাইন্না। নাফসে আম্মারা ‘পাপাকৃষ্ট সত্তা’, যে পাপে অনুরক্ত ও পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। (সুরা-১২ ইউসুফ, আয়াত: ৫৩)। নাফসে লাউওয়ামা ‘অনুতপ্তসত্তা’; যে শয়তানের ধোঁকায় বা রিপুর তাড়নায় অথবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে সাময়িক পাপ করে এবং লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে তওবাও করে। অর্থাৎ কখনো পাপে অনুরাগ আবার কখনো তাতে অনুতাপ হয়। (সুরা-৭৫ কিয়ামাহ, আয়াত: ২)। নাফসে মুতমাইন্না ‘প্রশান্ত আত্মা’, যার পাপের প্রতি বিরাগ এবং নেকির প্রতি অনুরাগ থাকে। (সুরা-৮৯ ফাজর, আয়াত: ২৭-৩০)।
নাফসে আম্মারা ও নাফসে লাউওয়ামাকে নাফসে মুতমাইন্নায় পরিণত করাই রমজানের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তাকে তার অসৎ কর্ম ও সৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে নিশ্চিত সফল হলো, যে তার নাফসকে পবিত্র করল; আর সে ব্যর্থ হলো, যে নাফসকে কলুষিত করল।’ (সুরা-৯১ শামস, আয়াত: ৮-১০)। নাজাতের অর্থ হলো সব দোষত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত করা ও পবিত্র রাখা এবং সদগুণাবলি অর্জন করে স্থায়ী মুক্তি নিশ্চিত করা। যাতে নাফসে মুতমাইন্না অবস্থা থেকে পুনরায় লাউওয়ামা বা আম্মারার দিকে ফিরে না যায়।
নাজাত বা মোহমুক্তির উপায় হলো তাওবাহ ও ইস্তিগফার করা। তওবা মানে হলো পাপ ছেড়ে পুণ্যে মনোনিবেশ করা। ইস্তিগফার হলো কৃত অপরাধের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়েÿক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পুনরায় ওই অপরাধ বা পাপ না করার অঙ্গীকার করা ও দৃঢ়সংকল্প হওয়া।
জাগতিক সব মোহ–মায়া আকর্ষণ থেকে মুক্ত হওয়ার চমৎকার একটি মাধ্যম হলো ইতিকাফ। এতে বান্দা সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর দিকে পালিয়ে আসো।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ৫০)। পাপ থেকে পাপের অকল্যাণ ও অমঙ্গল থেকে, পাপের ভয়ংকর ভয়াবহ মন্দ পরিণতি থেকে সর্বোপরি পাপের আকর্ষণ ও মোহ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ও মুক্ত হওয়ার জন্যই ইতিকাফ। হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম মহিমান্বিত রজনী শবে বরাত প্রাপ্তির জন্য ইতিকাফ। রমজানের বিশেষ সুন্নতে মুআক্কাদা কিফায়া আমল ইতিকাফ। ইতিকাফ তাকওয়ার রুদ্ধদ্বার প্রশিক্ষণ।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি
সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]