ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বিভিন্ন সময় দাবি করেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। অথচ বাস্তবতা হলো, ডলার-সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য হ্রাস, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি-সংকট—সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি ও জনজীবন বিপর্যস্ত।
এক দিক থেকে এসব সংকটের কারণ মূলত ব্যালান্স অব পেমেন্ট বা বৈদেশিক বিনিময়ের ভারসাম্যের সমস্যা। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমছে, প্রয়োজনীয় জ্বালানি কিংবা কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়া কিংবা রিজার্ভ হ্রাস পাওয়ার এ অর্থনৈতিক ঘটনার পেছনে যেসব ঘটনা, সিদ্ধান্ত ও প্রক্রিয়ার ভূমিকা রয়েছে, তা পুরোপুরি রাজনৈতিক।
সরকারের পক্ষ থেকে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হলেও ক্রমবর্ধমান বাজেটঘাটতি, বাণিজ্যঘাটতি, ব্যাংক ঋণ নিয়ে কিংবা আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে বিদেশি পুঁজি পাচার, ঋণনির্ভর ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে অবকাঠামো প্রকল্প ও রপ্তানিকারকদের ঋণ প্রদান কিংবা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধির মতো ঘটনাগুলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার বহু আগে থেকেই ঘটছিল। দেশের শাসনব্যবস্থায় ন্যূনতম জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিকতার চর্চা থাকলে বছরের পর বছর এসব ঘটনা ঘটতে পারত না।
দেশের মধ্যে জবাবদিহিবিহীন একচেটিয়া শাসনব্যবস্থায় যত বেশি উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তত বেশি দুর্নীতি হয়েছে, তত বেশি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। এককেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে ঋণের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে।
সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংকে একের পর এক জালিয়াতি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটার পরও নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি প্রতিষ্ঠার বদলে উল্টো ব্যাংকমালিকদের হাতে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ অবারিত করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের আইনি ও নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে।
বেসরকারি ব্যাংকের মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের মোট মূলধনের মাত্র ১০ শতাংশ বিনিয়োগ করে সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকার আমানত নিয়ন্ত্রণ ও ঋণের নামে লুণ্ঠনের অভিযোগ থাকলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকার ব্যাংক পরিচালক পদের মেয়াদ ৬ থেকে ৯ বছর করেছিল।
এবারও বিরোধী দলের তীব্র আপত্তির মধ্যেই ব্যাংকমালিকদের প্রস্তাব অনুসারে নির্বাচনের আগে ব্যাংকের পরিচালকদের মেয়াদ ৯ থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে।
এর ফলে যাঁরা ২০১৮ সালে পরিচালক হিসেবে ব্যাংকে বসেছেন, তাঁদের ২০৩০ সাল পর্যন্ত পরিচালক পদে থাকতে কোনো বাধা থাকবে না। শুধু তা-ই নয়, সংশোধনী অনুসারে, গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানকেও ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য করার বিধান শিথিল করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে ঋণ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
আমদানির সময় পণ্যের মূল্য বেশি এবং রপ্তানির সময় মূল্য কম দেখানোর ঘটনা ঘটেছে নিয়মিত। এভাবে উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি, ব্যাংক থেকে লোপাট করা ঋণের অর্থ ও আমদানি-রপ্তানিতে মূল্যের তারতম্যের মাধ্যমে বিদেশে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের চাপ তৈরি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, স্রেফ বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির মূল্য বেশি দেখানো এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৮২৭ কোটি ডলার বা ৮২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা (১ ডলার সমান ১০০ টাকা ধরে) পাচার হয়। (ট্রেড-রিলেটেড ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোস ইন ১৩৪ ডেভেলপিং কান্ট্রিজ ২০০৯-২০১৮, গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি, পৃষ্ঠা ৫৬) ক্ষমতাসীন সরকারকে যদি এসব বিষয়ে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হতো, তাহলে এভাবে বছরের পর বছর বিদেশে ডলার পাচারের ঘটনা ঘটতে পারত না।
দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয়, বিশেষ করে উঠতি ধনীদের কাছ থেকে সরকারের প্রত্যক্ষ কর আহরণ সেই তুলনায় বাড়েনি। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। ফলে সরকারের বাজেটঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই রকম ক্রমবর্ধমান ঘাটতি বাজেটের মধ্যে আবার বছর-বছর ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
ঘাটতি বাজেটের মধ্যে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের বাড়তি ব্যয় মেটানোর জন্য তাই দেশি ও বিদেশি নানা উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে, যা আবার বাজেটের ওপর সুদ পরিশোধের চাপ বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের চলমান রিজার্ভ-সংকটের একটা কারণ হলো, বিদেশি ঋণ নিয়ে এমন সব ব্যয়বহুল ও অপচয়মূলক প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে, যা থেকে রিজার্ভঘাটতি পূরণের মতো পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে না। তা ছাড়া ঋণ নিয়ে করা প্রকল্পের ব্যয় যদি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তাহলেও সেই প্রকল্প আর অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক থাকে না।
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এককেন্দ্রিক হয়ে যায়, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চেক অ্যান্ড ব্যালান্স থাকে না, ফলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশের জন্য বড় ধরনের বিপদ তৈরি হয়।
বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোর একটা সাধারণ প্রবণতা হলো, প্রকল্পগুলো নির্মাণের সময় ও ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। পরিকল্পনার ত্রুটি, অনিয়ম, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে মেগা প্রকল্পের ব্যয় বারবার বেড়ে যায়, যে কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক, বিদ্যুৎকেন্দ্র বা মেট্রোরেলের অভিধা জুটেছে এসব প্রকল্পের গায়ে।
এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সতর্কভাবে ঋণনির্ভর প্রকল্প নেওয়ার বদলে উল্টো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে অবকাঠামো প্রকল্পে এবং রপ্তানিকারক ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে এভাবে ঋণ দেওয়া যে ঝুঁকিপূর্ণ, সে বিষয়ে মূলধারার অর্থনীতিবিদেরাই সতর্ক করেছিলেন, তা নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখিও হয়েছিল। কিন্তু এসব সতর্কবার্তাকে আমলে নেওয়া হয়নি। ফলাফলস্বরূপ রিজার্ভ-সংকটের মধ্যেই পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলে ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং’ প্রকল্পের কাজের বিল বাবদ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে গত ফেব্রুয়ারিতে ১৭০ মিলিয়ন ইউরো বা ১৮৩ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ঋণচুক্তি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে আরও প্রায় ২৭৭ মিলিয়ন ইউরো।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে অন্যতম দায় রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেশি-বিদেশি বেসরকারি মালিকানাভিত্তিক ও বিদেশি ঋণনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও আমদানিনির্ভর জ্বালানি পরিকল্পনার। বিদ্যুৎসংকট সমাধানের কথা বলে বেসরকারি মালিকানায় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে সেগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেওয়া হয়েছে এবং দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ না নিয়ে বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল এলএনজি ও কয়লা আমদানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আর এসব কাজ করতে গিয়ে সরকারকে যেন কোনো জবাবদিহি করতে না হয়, সে জন্য রীতিমতো আইন করে, এমনকি আদালতে বিচার চাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত রহিত করা হয়েছে। [বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০, ধারা ৯ ও ১০]
গণতন্ত্রের সংকটে থাকা কর্তৃত্ববাদী ধরনের সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না বলে এ ধরনের সরকারগুলো বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে। এটা স্বল্প মেয়াদে বিশেষ বিশেষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিপুল মুনাফার জোগানের ব্যবস্থা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন। অর্থাৎ, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা স্বল্প মেয়াদে কতিপয় ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীকে সুবিধা করে দিতে গিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের ব্যবসা ও অর্থনীতিকে সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়।
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কতিপয় দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীর অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিতে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব ব্যবসায়ীকেও। কখনো এলএনজি, কখনো কয়লা বা তেল-সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে, এ কারণে লোডশেডিংয়ে শিল্পকারখানায় উৎপাদনে ধস নামছে।
লোডশেডিংয়ের সময় যাঁরা নিজস্ব জেনারেটরে কারখানা চালাচ্ছেন, তাঁদের উৎপাদনের খরচ ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকাংশ কারখানার জেনারেটর দিয়ে চালানোর সামর্থ্য না থাকায় লোডশেডিং বেড়ে গেলে দিনের একটা বড় সময় শ্রমিক ও যন্ত্রপাতিগুলোকে কাজে লাগানো যায় না, বিদ্যুতের ঘন ঘন যাওয়া-আসার কারণে কারখানার যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল নষ্ট হয়। এ কারণে রপ্তানি পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত, বিদেশি ক্রেতা হারানো ও জরিমানার আশঙ্কা তৈরি হয়।
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এককেন্দ্রিক হয়ে যায়, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক চেক অ্যান্ড ব্যালান্স থাকে না, ফলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশের জন্য বড় ধরনের বিপদ তৈরি হয়। বাজেট ও বাণিজ্য ঘাটতির মধ্যেই একের পর এক ব্যয়বহুল বিদেশি ঋণনির্ভর ‘প্রেস্টিজ প্রকল্প’ গ্রহণ, দায়মুক্তি আইনের আশ্রয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয়বহুল, আমদানিনির্ভর পরিকল্পনা, বৈদেশিক ঋণ ও রিজার্ভের অপব্যবহারের ঘটনাগুলো এ ধরনের এককেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেরই ফল।
তা ছাড়া জবাবদিহি না থাকার কারণে বড় বড় সিদ্ধান্তের পেছনে জনস্বার্থের বিবেচনার চেয়ে স্বেচ্ছাচারী ও বিভিন্ন গোষ্ঠী স্বার্থের প্রাধান্য থাকে। আবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকায় তৃণমূল থেকে পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে যায় না বা গেলেও বানানো পরিসংখ্যানের মাধ্যমে তা আড়াল করে রাখার সুযোগ থাকে, যা একপর্যায়ে বড় বিপদ ডেকে আনে।
গণতন্ত্রের গুরুত্বের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে অমর্ত্য সেন তাঁর ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম’ বইয়ে গণতন্ত্রের সুরক্ষামূলক ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, যখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে, তখন গণতন্ত্রের এই সুরক্ষামূলক ভূমিকার গুরুত্ব অনেক সময় ততটা টের পাওয়া যায় না। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি হলে টের পাওয়া যায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য গণতন্ত্রের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণস্বরূপ তিনি ১৯৯৭ সালের এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট প্রসঙ্গ তুলে বলেছেন, এসব দেশের অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে দেশগুলোর আর্থিক ও বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছ, জবাবদিহির অভাব ও নীতিনির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকার সম্পর্ক রয়েছে। এসব দেশে যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর থাকত, তাহলে হয়তো বিনিয়োগের ধরন ও ঝুঁকি বিষয়ে আরও গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করে তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো।
ওই সব দেশে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়ে যাওয়ার পর গণতন্ত্রের অভাব সবচেয়ে বেশি করে বোঝা গেছে। কারণ, অর্থনৈতিক সংকটে সব হারানো মানুষগুলোর দুর্দশার কথা শোনারও কেউ ছিল না তখন। স্রেফ কয়েক শতাংশ জিডিপির সংকোচনই লাখ লাখ মানুষের জীবনে মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, যদি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দায় সবাই সমানভাবে বহন না করে, যদি বেকার ও সদ্য ছাঁটাই হওয়া মানুষের ঘাড়েই তার বেশির ভাগটা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ কারণেই তিনি লিখেছেন, ‘দ্য প্রোটেকটিভ রোল অব ডেমোক্রেসি ইজ স্ট্রংলি মিসড হোয়েন ইট ইজ মোস্ট নিডেড’। অর্থাৎ, ‘গণতন্ত্রের সুরক্ষামূলক ভূমিকার অভাব তখনই সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়, যখন এর প্রয়োজনটা সবচেয়ে বেশি থাকে।’
বাংলাদেশে যাঁরা উন্নয়নকে গণতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে এত দিন উন্নয়নের নেশায় আচ্ছন্ন ছিলেন, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে তাঁরা হয়তো দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন একটা দেশের শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক জবাবদিহির গুরুত্ব কতখানি।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: [email protected]