২৩ আগস্ট গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেল যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক ও বেসামরিক খাতে আরও কয়েক শ কোটি ডলারের সহযোগিতা দেবে। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ডলার দেওয়া হবে ‘নিরাপত্তাসহায়তা’ হিসেবে। ভূমি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য অগ্রসর প্রযুক্তির ৬টি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, লেজারনিয়ন্ত্রিত রকেট–ব্যবস্থা, ২ লাখ ৪৫ হাজার রাউন্ড ১৫৫ মিলিমিটার আর্টিলারি গোলা ও ৬৫ হাজার রাউন্ড ১২০ মিলিমিটার মর্টারের গোলা সহায়তা হিসেবে ইউক্রেনকে দেওয়া হবে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর প্রাণঘাতী অস্ত্র ও মানবিক কাজে কিয়েভকে মোট ৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর অর্থ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের অনমনীয় মানসিকতার যুদ্ধে শর্তহীনভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেন চায় ক্রিমিয়া ও দনবাস অঞ্চল পুনর্দখল ও পুনরেকত্রীকরণ করতে। যুদ্ধে পশ্চিমাদের যে লক্ষ্য, তা থেকে কিয়েভের এ অবস্থান অনেকটাই ভিন্ন। কেননা, পশ্চিমা নেতারা চান মস্কোর শর্তহীন আত্মসমর্পণ। আর ওয়াশিংটনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে সেটা পুতিনের জমানার বদল।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে দেওয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিবেচনা করলে যে কেউই এর সত্যতা পাবে। রাশিয়ার অর্থনীতি গুঁড়িয়ে দেওয়া এবং রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের বাজার ধসিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আরোপ করা হয়েছে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা। প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের মিত্রদেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমের প্রক্সি যুদ্ধকে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে।
কিয়েভের অনমনীয় মনোভাবের এই যুদ্ধ খুব সহজেই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছে। কেননা, দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এ ধরনের অনমনীয় বা কট্টর নীতির চর্চা করে আসছে। ১৯৯০-এর দশকে কলামিস্ট উইলিয়াম পাফ তাঁর একটি লেখায় উল্লেখ করেন, আধুনিক কালে মার্কিনদের পররাষ্ট্রনীতির সবটাই একটি প্রোটেস্ট্যান্ট ধারণা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সেটা হলো ঈশ্বরিক পরিত্রাণমূলক ধারণার ইহজাগতিক কর্মকাণ্ড।
বাইডেনের নীতিমালাবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি কলিন কাহল বলেছেন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন মেটানোর জন্য ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।...যাতে করে ইউক্রেন এ মুহূর্তে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে এবং আগামী এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত আগ্রাসন রুখে দিতে পারে। তাঁর এই বক্তব্য থেকে বুঝতে আর বাকি থাকে না যে যুক্তরাষ্ট্র চায়, যুদ্ধটা যাতে আরও এক থেকে দুই বছর স্থায়ী হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন উড্রো উইলসন। উড্রো উইলসন এ মহাযুদ্ধকে ‘শেষ যুদ্ধ’ বলে মনে করতেন। পাফ বলেন, এ ধরনের নৈতিক চরমপন্থী অবস্থান কোনো ধরনের আপস রফার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। কূটনীতিক ও বিশ্লেষক জর্জ এফ কেনানও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে উড্রো উইলসনের এ ধরনের কট্টর নীতির বিরোধিতা করেছিলেন।
১৯৫১ সালে একটি নিবন্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উইলসনের কট্টর নীতি সম্পর্কে কেনান লেখেন, কোনো অবস্থাতেই এই নীতি যুদ্ধরত জনসাধারণের জন্য যুক্তিযুক্ত কিংবা নমনীয় কিংবা আপসের মনোভাব তৈরি করে না। বৈরিতা তাদের চালনা করে এবং তাদের মধ্যে পুঞ্জীভূত ঘৃণা থাকে, সে কারণে নিজেদের পক্ষের প্রচারণাকেই তারা বিশ্বাস করে। এ অবস্থায় যারা মধ্যপন্থী অবস্থান পোষণ করতে চেষ্টা করে, জোর করে তাদের কণ্ঠস্বর থামিয়ে দেওয়া হয় কিংবা তাদের অপবাদ দেওয়া হয়। আর এভাবেই যুদ্ধের লক্ষ্য কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। সর্বত্রই তা তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের বাগাড়ম্বরে ভরা বক্তব্যে এখন আবার অনমনীয় ভাষার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। মার্চের কথা স্মরণ করুন। পোল্যান্ডে একটি সমাবেশে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রকাশ্যে মস্কোয় পুতিনের শাসন পরিবর্তনের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ঈশ্বরের দোহাই, এই লোকটা (ভ্লাদিমির পুতিন) আর ক্ষমতায় থাকতে পারেন না।’ বাইডেন ও তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টারা বারবার করে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে সতর্ক করেছে এই বলে, ‘আমাদের আগামীর দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য নিজেদের শক্ত করে প্রস্তুত করা প্রয়োজন।’
বাইডেনের নীতিমালাবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি কলিন কাহল বলেছেন, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজন মেটানোর জন্য ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।...যাতে করে ইউক্রেন এ মুহূর্তে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে এবং আগামী এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত আগ্রাসন রুখে দিতে পারে। তাঁর এই বক্তব্য থেকে বুঝতে আর বাকি থাকে না যে যুক্তরাষ্ট্র চায়, যুদ্ধটা যাতে আরও এক থেকে দুই বছর স্থায়ী হয়।
যুদ্ধ নিয়ে কিয়েভের অনমনীয় মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য পূরণের মইয়ের একটার পর একটা সিঁড়ি পেরোতে সহায়তা করছে। কেনান লিখেছিলেন, উঁচু নৈতিকতার নামে শুরু হওয়া যেকোনো যুদ্ধ যদি খুব দ্রুত নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে খুব দ্রুত সেটি আধিপত্যের যুদ্ধে পরিণত হয়।
কেনানকে আমাদের সময়কার উন্মাদনা দেখতে হয়নি। পাফও ২০১৫ সালে মারা গেছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিপ্রণেতাদের মধ্যেও কীভাবে উইলসনের উত্তরাধিকার বয়ে চলেছে, তার যথেষ্টই তাঁরা জীবদ্দশায় দেখে যেতে পেরেছেন। পাফ লিখেছেন, এটা ব্যাখ্যা করা কঠিন, কেন উইলসনের এই মৌলবাদী ভাবাবেগ, আত্মগরিমা ও অনৈতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি গণতন্ত্রের দৃষ্টান্ত হিসেবে সারা বিশ্বকে গ্রহণ করতে হবে। ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিকান দুই পক্ষই কেনই–বা সেই একই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কেনই–বা নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্দীপনা জুগিয়ে যাবে।
উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, সে রকম বাগাড়ম্বরময় বক্তব্য কিংবা শতকোটি ডলারের প্রাণঘাতী অস্ত্রের অস্তিত্ব ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কল্পনা করা যায় না। গত শতাব্দীর একটা দীর্ঘ সময়জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এমনভাবে আবর্তিত হয়েছে যেন মার্কিনরা ত্রাণকর্তা। চলমান সংঘাতে মস্কোর সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার যেকোনো সম্ভাবনা শুধু খাটো করে দেখা হবে না, সেটা বাতিলও করে দেওয়া হবে। যেকোনো মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের ধর্মযুদ্ধ যে সঠিক, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে চান।
জেমস কার্ডেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় প্রেসিডেনশিয়াল কমিশনের সাবেক উপদেষ্টা
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে