প্রদীপ বা চেরাগের নিচেই থাকে অন্ধকার। অবশ্য এ অন্ধকারের ব্যাপ্তি সামান্যই; ব্যবহারকারীর জন্য তা তেমন ব্যাঘাতের কারণ হয়ে ওঠে না। কিন্তু চেরাগটা যদি হয় আলাদিনের? তাহলে? সেই চেরাগের নিচের অন্ধকার কতটা ছড়ায়? সেই চেরাগের আলোয় বিদেশের কোনো ‘স্বর্গপুরী’ কতটা আরও ঝলমল করছে, তার কিছু ‘আলোকিত’ আন্দাজ সংবাদমাধ্যমের সূত্রে পাওয়া যায় বৈকি, কিন্তু এর জেরে দেশের কত মানুষ যে অন্ধকারে তলিয়ে গেল কিংবা যতজনের জীবনে আলোর রেখা দেখা দিতে পারত, সেই সম্ভাবনা আরও কতটা দূরে নিপতিত হলো, কে রাখে খবর তার!
দেশটা তবু এগিয়ে যাচ্ছে। একবার বলাই যায়—মারহাবা!
দেশের ‘উন্নয়নের’ সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর যে কয়টি বিষয় ধাই ধাই করে এগিয়ে চলছে, তার একটি ‘অর্থ পাচার’ হলে অপরটি ‘খেলাপি ঋণ’। এর কোনটি প্রথমে, কোনটির অবস্থান দ্বিতীয়, সেটি নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু ‘আলাদিনের চেরাগ’ যে একশ্রেণির মানুষের জীবন আলোকিত করেছে এবং করছে, তা নিয়ে দ্বিমত করার বিশেষ কিছু নেই। আরেকবার খাসদিলে মারহাবা বলার সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না; বলুন—মারহাবা!
দেশে দেশে কত বেগমপাড়া, করস্বর্গ বা বিনিয়োগের অভয়ারণ্যে বাংলাদেশিরা স্বমহিমায় জায়গা করে নিয়েছেন, ‘সেকেন্ড হোম’ বানিয়ে আয়েশি ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করেছেন, তার সর্বশেষ স্পষ্ট আলামত পাওয়া যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধির উল্লম্ফনে।
দুবাই চেম্বার অব কমার্সের হিসাব বলছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধেই (জানুয়ারি থেকে জুন মাস) বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সদস্যপদ নেওয়ার হার বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। এই ছয় মাসে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন ১ হাজার ৪৪টি কোম্পানি সদস্যপদ নিয়েছে দুবাই চেম্বারের। এতে দুবাই চেম্বারের সদস্যপদ পাওয়া বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন কোম্পানির মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৯৭৫।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিবরণী অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। অর্থাৎ এ বাজেটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশের সমপরিমাণ অর্থ অন্যের সিন্দুকে গেছে। সিন্দুকটি দেশে, না বিদেশে—সে প্রশ্ন নাহয় ঊহ্যই থাক!
না বললেও যে কথা বিলকুল বোঝা যায়, তা হলো বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বিনিয়োগের অনুমতি নিয়ে কেউ এসব ব্যবসা-বাণিজ্য করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত মাত্র ১৭ প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমোদন নিয়ে বিদেশে কার্যালয় কিংবা ছোট আকারের কারখানা গড়ে তুলছে। অর্থাৎ এক দুবাইয়েই রয়েছে অনুমোদিত সংখ্যার প্রায় ৬৫০ গুণ বেশি কোম্পানি।
কোথাও কোনো হেলদোল কি চোখে পড়ে, কোনো হইচই কানে আসে? তাই বলে যে ‘কঠোর’ কিছু ব্যবস্থার কথা একেবারে জানা যায় না, তা অবশ্য নয়। এই তো ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এর মানে সরকারের মাথায় বিষয়টি আছে।
তবে দেখা যাচ্ছে, ওই অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে কেউ এক টাকাও দেশে ফেরত আনেননি। শর্ত ছিল, ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা টাকা আনলে টাকাওয়ালাকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। সরকারের এই পদক্ষেপ ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ বাগধারাই মনে করিয়ে দেয়। পাচার ঠেকানোর ‘উদ্যোগ’ নেই, অন্যায়ভাবে আয়ের ক্ষেত্র ‘বিস্তৃত’, আইনে প্রয়োগ ‘নামকাওয়াস্তে’; এরপর পগার পার হওয়ার বলব, ‘বাবাজি, ফিরে এসো’! কেউ আসবে?
আর এ ধরনের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি নৈতিকভাবেই–বা কতটা সমর্থনযোগ্য? রাজনৈতিকভাবেও কি অগ্রহণযোগ্য নয়? এর মাধ্যমে নিয়মিত করদাতাদের প্রতি কতটা অন্যায় করা হয়েছে, সে বিষয় নাহয় আলোচনার বাইরেই থাক। সুতরাং কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অন্যায় হবে? সরকারের পুরো ব্যবস্থা ঠিকঠাক সক্রিয় থাকলে আজ পর্যন্ত একজন পাচারকারীরও শাস্তির কথা কেন জানা গেল না?
তবে যা অজানা থাকছে না, তা হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে; এই হিসাব ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই)। আর ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা গচ্ছিত ছিল (সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন)।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হালনাগাদ বিবরণী অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। অর্থাৎ এ বাজেটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশের সমপরিমাণ অর্থ অন্যের সিন্দুকে গেছে। সিন্দুকটি দেশে, না বিদেশে—সে প্রশ্ন নাহয় ঊহ্যই থাক!
আপনাকে অঙ্কে কাঁচা বলা যাবে না, বরং আপনার বেঁচে থাকাটাই অঙ্কনির্ভর। প্রতিদিনই আয়-ব্যয়ের হিসাব কষতে হয়। তবু জীবনব্যাপী কিছু হিসাব আপনি মেলাতে পারবেন না। যেমন বাংলাদেশটা ধনী নয়, অথচ এটি সবচেয়ে বেশি ধনী তৈরির দেশ। কীভাবে? বোঝা গেল?
না বুঝতে পারলে ধরে নিন এটাও আরব্য রজনীর কোনো গল্প, যেমনটা ‘আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ’।
হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]