বিশ্বকাপ হকি আমাদের পাশের দেশে হয়ে গেল। ফাইনাল হলো গত ২৯ জানুয়ারি। খবরটি আমাদের কয়জন জানি? আমরা কি জানি বিশ্বকাপ হকিতে খেলে ১৬টি দেশ। আর আমাদের র্যাঙ্কিং? ২৯। নিয়মিত ঘরোয়া খেলা না থাকায় এই অবনমন। কিন্তু জেনে অবাক হবেন, ২০১২ থেকে ২০১৪ সালেও বিশ্ব হকি লিগে আমাদের অবস্থান ছিল ১৯। এশিয়া কাপ হকিতেও আমরা একসময় ছিলাম পঞ্চম (১৯৮৫)। কিন্তু অন্য অনেক খেলার মতো আমাদের হকিও শুধু পিছিয়েছে।
হকিতে একটা দারুণ উদ্যোগ ছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। খবরে প্রকাশ, এখনো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলা বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা পুরো টাকা পাননি। কিন্তু যেখানে ক্রিকেটের বিপিএল বিদেশি ভালো খেলোয়াড় আনতে ব্যর্থ, সেখানে হকি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নিয়ে এসেছিল বেশ কিছু বিশ্বকাপ খেলা তারকা খেলোয়াড়। ২০২১ সালে সর্বশেষ হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার হকি লিগে ঢাকা মোহামেডানে খেলে যাওয়া গঞ্জালো পেইলাত বিশ্বকাপ হকিতে জার্মানিকে চ্যাম্পিয়ন করতে সেমিতে হ্যাটট্রিক, ফাইনালে গোলসহ অনেক ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগই কি শেষ কথা?
১৯৮৫ সালে এশিয়া কাপ হকি ঢাকাতে হওয়ার পর দেশে হকির জাগরণ হয়েছিল। তারপর ফুটবল-ক্রিকেট যখন মাঠ নিয়ে মারামারি করত, তখন তাদের ছিল নিজেদের মাঠ। মাঠে দর্শক আসত, মারামারি হতো। তারপর সেই সময় আবাহনী, মোহামেডান, ঊষা নিয়ে আসত সেরা বিদেশিদের। কিন্তু ভালো বেশি দিন সহ্য হয়নি। লিগ হয়ে গেল অনিয়মিত। ক্রিকেটের উত্থানে কমে গেল মানুষ। সেই সময় অনেক খেলোয়াড় খেলা ছেড়ে দেয়। ঢাকার বাইরের লিগগুলোও বন্ধ হয়ে গেল। স্কুল হকিও। খেলোয়াড়দের পাইপলাইনও নেই।
আমাদের ঘরোয়া লিগের সব থেকে বড় অংশ হচ্ছে ক্লাব হকি। আমাদের লিগ ক্লাবগুলোর কাছে জিম্মি। তারা ফেডারেশনের কাছে টাকা চায়। পৃথিবীর কোন দেশের ক্লাবগুলো খেলার জন্য ফেডারেশনের টাকা নেয়, আমার অন্তত জানা নেই। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের তলানি থাকা ক্লাব ফুটবলে কিছু ক্লাব টাকার বস্তা নিয়ে ঘুরে, ক্রিকেটের কথা বাদই দিলাম। আর দুঃখের কথা হচ্ছে তাদের খেলা থাকে মাত্র দুই–তিন মাস। হকির জাগরণের জন্য ক্লাব হকির সংস্কার অবশ্যই প্রথম দরকার।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বিষয় এখনো হকি ফেডারেশন কখনো কোনো ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা দিতে পারেনি। তাদের নিজস্ব যে ওয়েবসাইট আছে, তা ২০১৫-এর পর আপডেট নেই। পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালেই দেখা যায় তাদের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো ক্যালেন্ডার সাজানো; শুধু জাতীয় পর্যায়ে নয়, কোন প্রদেশে কী হবে, না হবে—সবই এই ক্যালেন্ডারে পাওয়া যাবে। বাস্তবতায় আসি একটু।
হকি ফেডারেশন যদি হুট করে আমূল পরিবর্তন চায়, তাহলে সম্ভব নয়। তারা বরং আগে যা করতে পেরেছে, শুধু সেটাই নিয়মিত করতে পারে। আমাদের ক্লাব হকি মৌসুমকে তিন মাসের জায়গায় ছয় মাসে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। ক্লাবগুলো এত টাকা খরচ করে নিশ্চয় তিন মাসের জন্য দল বানায় না। আর খেলোয়াড়েরাও শুধু তিন মাস খেলে বাকি মৌসুম বসে থাকতে চান না। এত সুন্দর একটা মাঠ, ফেলে রাখাও তো দৃষ্টিকটু।
আমাদের ক্লাব পর্যায়ে ক্লাব কাপ হকি আর দুই লেগের লিগ—এই দুই আয়োজনের চেষ্টা চলে। আর অনিয়মিতভাবে আয়োজিত হচ্ছে স্বাধীনতা দিবস আর শহীদ স্মৃতি হকি। ফেডারেশনের উচিত এই চারটা টুর্নামেন্ট নিয়মিত আয়োজন করা; যা আসলে খুবই সহজ ও সম্ভব। আর তারা নিজেরাই আগে এটা করে দেখিয়েছে। জানুয়ারিতে ক্লাব কাপ হকি, ফেব্রুয়ারিতে লিগের প্রথম রাউন্ড, মার্চে স্বাধীনতা কাপ, এপ্রিলে মিড ট্রান্সফার (বিদেশিদের জন্য) লিগের দ্বিতীয় রাউন্ড। জুনে গিয়ে শহীদ স্মৃতি হকি। এর মাঝে জাতীয় দলের খেলা থাকবে, পরে হবে জাতীয় লিগ। এর মধ্য দিয়ে প্রায় সারা বছর খেলা থাকবে। এটা হকি ফেডারেশনের জন্য চ্যালেঞ্জ। আর তাদের পক্ষে এটা সম্ভবও বটে।
এবার আসি সংস্কারের প্রশ্নে, সংস্কারটা হবে কোথায়?
ফুটবলে নিয়ম আছে কোচিংয়ের ন্যূনতম ডিগ্রি না থাকলে কোচিং করাতে পারবেন না। হকি কোচিংয়ে দরকার ট্রেনার। ক্লাবগুলোর জন্য একজন সনদপ্রাপ্ত ট্রেনার থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। খুব খরচ কি বাড়বে এতে? ঢাকার হকিতে কোনো কোনো ক্লাব অতীতে বিদেশি কোচিং স্টাফ নিয়ে এসেছিল। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে সব দলেই ছিল বিদেশি কোচ। এভাবে সব দল যদি ট্রেনার আনে, সব থেকে বেশি লাভ হবে হকির। সঙ্গে দেশি পুষ্টিবিদ দিয়ে খাদ্যতালিকা ঠিক করে দেওয়া। এগুলো করতে পারলে খেলায় গতি বাড়বে এবং জাতীয় দলেরও বাড়বে সক্ষমতা।
বাংলাদেশের হকি লিগে খেলে গেছেন শাহবাজ আহমেদ, তাহির জামান, ধনরাজ পিল্লাইদের মতো বড় তারকারা। সেই সময়ই আসলে হকির উন্নতি শুরু হয়। কিন্তু এখন সব স্থবির। আমাদের বিদেশে বেশি খেলার সুযোগ নেই। আগে ভারতের নেহরু কাপ এবং লাল বাহাদুর শাস্ত্রী কাপে বাংলাদেশ দল নিয়মিত খেলতে যেত, এখন কেউ মনে হয় নিজে থেকে খবরও রাখে না।
আমরা সব দলের থেকে আসলে পিছিয়ে আছি ওই ফিটনেসের জায়গায়। খেলোয়াড়দেরও এই ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তাঁদের নিজেদের ফিটনেস, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করে প্রস্তুত রাখা উচিত। স্বাধীনতা কাপ শুধু দেশিদের নিয়ে হতে হবে। এটা চাইলেই নিয়ম করে দেওয়া যায়। এতে অন্তত ৪০ জন নতুন খেলোয়াড় সুযোগ পাবেন।
আর সারা দেশে হকিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শহীদ স্মৃতি হকি হতে হবে ঢাকার বাইরে। একেক বছর একেক জেলায় হলে তারা কাছ থেকে খেলোয়াড়দের দেখবে, খেলা চিনবে, তবেই না বাকিরা এই খেলায় আসবে। হ্যাঁ, যুক্তি হবে বাইরে তো টার্ফ নাই। আমাদের দেশে এখন ঢাকার বাইরে টার্ফ বসানো সম্ভবও নয়। তাই বলে কি খেলা শুধু ঢাকাতেই থাকবে? সারা দেশে না ছড়ালে মানুষ আসবে কীভাবে? তাই সব জেলা এবং সার্ভিসেস দল নিয়ে জাতীয় লিগ চালু করতেই হবে। খেলা হতে হবে হোম অ্যান্ড অ্যাওতে। সঙ্গে স্কুল হকি। বিকেএসপিই এখন হকিতে একমাত্র খেলোয়াড় সরবরাহ করছে। স্কুল হকি নিয়মিত করে যদি উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে আমাদের র্যাঙ্কিং আগানো ঠেকায় কে। শুধু ঢাকায় কিছু খেলা আয়োজন করলে এগোনো যাবে না। আর ঘাসের মাঠে খেললে খেলোয়াড়দের দক্ষতা বাড়ে, কমার তো প্রশ্নই আসে না।
আমাদের ইউরোপীয় কোচ ছিল। ২০০৬ সালে পাকিস্তানি ট্রেনার এরশাদ হায়দার আসছিলেন দেশে। কিন্তু এখন কোনো ট্রেনার নেই। ভিডিও অ্যানালিস্ট ছাড়া হকি অচল। আচিম মের্তেন্স এসেছিলেন ভিডিও বিশ্লেষক হিসেবে। হেইন্ডিরিকম্যান আসেন গোলকিপার কোচ হয়ে। দেশের ঘরোয়া লিগ নিয়মিত না হলেও আমাদের খেলোয়াড়েরা খেলেছেন জার্মান, ডাচ্, মালয়েশিয়ান লিগে।
বাংলাদেশের হকি লিগে খেলে গেছেন শাহবাজ আহমেদ, তাহির জামান, ধনরাজ পিল্লাইদের মতো বড় তারকারা। সেই সময়ই আসলে হকির উন্নতি শুরু হয়। কিন্তু এখন সব স্থবির। আমাদের বিদেশে বেশি খেলার সুযোগ নেই। আগে ভারতের নেহরু কাপ এবং লাল বাহাদুর শাস্ত্রী কাপে বাংলাদেশ দল নিয়মিত খেলতে যেত, এখন কেউ মনে হয় নিজে থেকে খবরও রাখে না। বাংলাদেশ হকি খেলোয়াড়দের ইউরোপের লিগে নিজ উদ্যোগে নিয়ে যান কোচ পিটার গেরহার্ড, এখন সেটাও নেই। কোনো টুর্নামেন্টের আগে হুড়োহুড়ি করে এক মাস আগে বিদেশি কোচ, নির্দিষ্ট করে বললে বিকেএসপিতে থাকা বিদেশি কোচ নিয়োগ দিয়ে দায় সারে ফেডারেশন। এই কাজ করার জন্য ফেডারেশনে সরকার মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটা কমিটিই যথেষ্ট, ফেডারেশনের নির্বাচিত কমিটি লাগে না।
কী ভাবছেন? দিবা স্বপ্ন! আমাদের দেশে প্রতিবছর পঞ্চাশ হাজার হকিস্টিক বিক্রি হয়, এগুলো যদি মাঠে নামানো যায়, হকি ফেডারেশন যদি পেশাদার হয়, বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন যদি খেলোয়াড়দের দেখানো যায় তাহলে হকি বিশ্বকাপের স্বপ্ন বাস্তব থেকে আসলে খুব বেশি দূরে নয়।
সুবাইল বিন আলম ফ্রিল্যান্স অ্যানালিস্ট, সাবেক রিসার্চ ফেলো এবং ক্রীড়া উপস্থাপক, কনসালট্যান্ট গোল বাংলাদেশ।
ই-মেইল: [email protected]