প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক অনেকটা আচমকাই ২২ মে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। ৪ জুলাই মানে আর ছয় সপ্তাহ পরেই যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন। অন্যবারের মতো এবারের নির্বাচনও বৃহস্পতিবারই অনুষ্ঠিত হবে। তবে সময়ের বিবেচনায় জুলাই মাস স্কটল্যান্ড ও নর্দান আয়ারল্যান্ডের মানুষের ভোট দেওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। কারণ, তখন সেখানে স্কুল বন্ধ থাকে। অনেকেই সেই সুযোগে ঘুরতে এদিক-সেদিক চলে যান।
প্রধানমন্ত্রী ঋষি এমন সময়ে নির্বাচনের ডাক দিয়েছেন যখন জরিপ বলছে, তাঁর দল কনজারভেটিভ পার্টি বিরোধী লেবার পার্টির চাইতে প্রায় ২০ পয়েন্টে পিছিয়ে আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে প্রয়োজন ৩২৬ আসনের। সেখানে গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত জরিপ বলছে, লেবার পার্টি অন্তত ৪৭২টি আসন পাবে। ক্ষমতায় থাকা কনজারভেটিভ পার্টির পাওয়ার কথা ৮৫টির মতো আসন। লিবারেল ডেমোক্র্যাট ও স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি যথাক্রমে ৫০ ও ১৯টির মতো আসন পেতে পারে। বাকি ছোট দলগুলো মিলে পেতে পারে ২৪টির মতো আসন। যেখানে ২০১৯ সালের নির্বাচনে লেবার পেয়েছিল ২০২টি আসন ও কনজারভেটিভ পার্টি ৩৬৫টি। লিবারেল ডেমোক্র্যাট ও স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি যথাক্রমে ১১ ও ৪৮টি আসন পায়। অন্য ছোট দলগুলো পেয়েছিল ২৩টির মতো আসন।
জরিপ বলছে, ক্ষমতাসীনদের অবস্থা খারাপ। তুঘলকি কোনো কিছু না ঘটলে কনজারভেটিভ পার্টির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা একেবারে নেই। তাহলে প্রশ্ন হলো, এখনই কেন ঋষি সুনাক নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন? আসলে আজ বা কাল এই বছরে নির্বাচনের ঘোষণা তাঁকে দিতেই হতো। তবে এই ঘোষণার পেছনে মূল কারণ হতে পারে যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি কমে আসা। যার ফলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রীর দাম কমে এসেছে।
ঋষি সুনাকের আরেক দাবি, জি-৭ দেশগুলোর ভেতর যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি সবচেয়ে ভালো করছে।
যদিও এর পেছনে বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো ভূমিকা নেই। এর অনেক পরিবর্তনই বাজারের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে ঘটেছে। তবু ঋষি এ রকম আরও কিছু বড় পরিবর্তনকে পুঁজি করে আসন্ন নির্বাচনে বাজি ধরতে যাচ্ছেন। তবে লেবার পার্টির দাবি, অর্থনীতি স্থবির হয়ে আছে। সামনে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনাও নেই। তা ছাড়া অবৈধ অভিবাসন বিষয়েও সরকারের তেমন কোনো সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তাহলে কি ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, না, নেই। জেনে রাখা ভালো যে ঋষি কিন্তু যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নন। তাঁর দলের সদস্যদের ভোটে তিনি দলীয় নেতা হয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাঁর দল প্রায় ১৪ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। শুরুর কয়েক বছর ছাড়া গত আট বছরে ঋষি সুনাকের দলের ভেতর কোন্দল শেষই হচ্ছে না।
৪ জুলাইয়ের নির্বাচন থেকে যে উত্তর পাওয়া যাবে তাকেও চূড়ান্ত হিসেবে ধরে নেওয়ার সুযোগ এখনই থাকছে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যিনি পরিকল্পনা করছেন, তাঁর জনপ্রিয়তার পরি যেকোনো সময় উড়ে গিয়ে তাঁর পদ আঁকড়ে থাকার বাস্তবতাকে কল্পনায় বদলে দিতে পারে। কারণ, নির্বাচনে জয়ই এখানে শেষ কথা নয়।
বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় টের পেয়েছিলেন যে ঋষি তাঁর জন্য হুমকি। তখনই গণমাধ্যমে ঋষি ও তাঁর স্ত্রীর কর ও সম্পত্তি-সংক্রান্ত বিভিন্ন খবর ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয়, এর নেপথ্যে ছিলেন বরিস। পরে ঋষিও চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালনের একপর্যায়ে বরিসের ওপর থেকে নিজের সমর্থন সরিয়ে নেন এবং পদত্যাগ করেন। ফলে বরিসকে ক্ষমতা থেকে সরতে হয়।
ঋষির মতো একই কাজ বরিসও করেছিলেন থেরেসা মের সঙ্গে। ব্রেক্সিট ইস্যুতে যাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। ব্রেক্সিট ইস্যুতে জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও বরিস জনসন তখন প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। কারণ, তিনি তাঁর দলের অবস্থা খুব ভালো করেই জানতেন। তিনি সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। বরিস ক্ষমতায় নেই, কিন্তু তাঁর ভূত এখনো ঋষিকে তাড়া করে ফিরছে।
দলে বরিসের প্রভাব এখনো বিদ্যমান। অনেকেই ঋষিকে অভিযুক্ত করেছেন এই বলে যে তিনি বরিসের পিঠে পেছন থেকে ছুরি মেরেছেন। তাঁর দল কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে আছে। বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট সংসদ সদস্য তাঁর ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছেন। গোপনে দলের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মজার বিষয় হচ্ছে, দলের বেশির ভাগ সদস্য চাইছেন পরাজয়ের দায়ভার ঋষির ওপর চাপাতে। তাই জরিপে এত পিছিয়ে থাকার পরও বেশির ভাগ সংসদ সদস্য চাইছেন সুনাকের নেতৃত্বে নির্বাচনে লড়তে। সহজ ভাষায় হারতে। যদিও অর্থনীতির দায়িত্বে থাকা চ্যান্সেলর জেরেমি হান্ট বলেছেন, তিনি তাঁর শরীরের সব হাড় দিয়ে লড়ে হলেও ঋষিকে ক্ষমতায় রাখতে চান। কিন্তু শুধু হাড়সর্বস্ব চেষ্টায় আপাতদৃষ্টিতে কোনো কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। হাড়ের সঙ্গে রক্ত-মাংস জোড়া দিলেও হারের ব্যবধান খুব একটা কমবে বলে মনে হচ্ছে না।
আসলে গত আট বছরে অন্তর্দলীয় কোন্দল কনজারভেটিভ পার্টিকে এতটা দুর্বল করে দিয়েছে যে ব্রিটিশ জনগণ তাদের ওপর অনেকটা বিরক্ত। বিশ্বনেতারাও তা-ই। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর তো বলেই ছিলেন, ব্রেক্সিট ব্রিটিশ গণতন্ত্রের চাওয়া ছিল না। ব্রেক্সিট ভঙ্গুর রাজনৈতিক দলের উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদদের চাওয়ায় ঘটেছে। কারণ, ব্রেক্সিট মোকাবিলার ন্যূনতম প্রস্তুতি তখনকার সরকার ও কনজারভেটিভ পার্টির ছিল না। এ তো গেল দলের ভেতরের অবস্থা। প্রতিদ্বন্দ্বী কিয়ার স্টারমারের তুলনায় সুনাক কেমন? উত্তর হলো, ভালো না। শুধু ভালো না বললে মিথ্যা বলা হয়। বলা উচিত খুবই খারাপ।
তাহলে কিয়ার স্টারমার কেমন? উত্তর হলো, উত্তম। ব্যক্তিগতভাবে কিয়ার স্টারমার খুব একটা জনপ্রিয় নন। কিন্তু লেবার পার্টির নেতা ও বিরোধী দলের প্রধান হিসেবে তিনি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন। স্টারমার চিরাচরিত লেবার ভোটারদের মধ্যে খুব একটা জনপ্রিয় নন। কারণ, তিনি মধ্যমপন্থী। অনেকটা টনি ব্লেয়ারের মতো। তাঁর রাজনৈতিক কৌশলকে তুলনা করা হচ্ছে মিং ডাইনেস্টির সময়ে তৈরি চীনামাটির মূল্যবান সাজসামগ্রীর সঙ্গে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, স্টারমার যেন মিং ডাইনেস্টির মূল্যবান কোনো ফুলদানি হাতে চলাফেরা করছেন। খুবই সাবধানে পা ফেলছেন। যেন ফুলদানি ভেঙে না যায়।
জেরেমি করবিনের হাত থেকে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরমুহূর্ত থেকে স্টারমার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যা করা দরকার করে চলছেন। কী ফিলিস্তিন, কী অভিবাসন কোনো কিছুতেই তিনি স্রোতের বিপরীতে যাননি। গোটা সময় রাজনৈতিকভাবে সঠিক থাকার চেষ্টা করেছেন। করবিনের আমলে হওয়া রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টোর মোটামুটি সবটা বদলে ফেলেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তাঁর দল অভূতপূর্ব সাফল্যও পেয়েছে।
তবে ফুলদানির রাজনৈতিক কৌশল ব্যক্তিগতভাবে কিয়ার স্টারমারকে খুব একটা সুবিধা দিচ্ছে না। জরিপ বলছে, ২০১৪ সালে ২৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশ মনে করতেন লেবার পার্টি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের জরিপে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে।
২০১৪ সালে ৫২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশ মনে করতেন যুক্তরাজ্য কী ধরনের সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, লেবার পার্টি তা বুঝতে পারে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের জরিপে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশে।
২০১৪ সালে ৩১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশ মনে করতেন লেবার পার্টির নেতৃত্বে ভালো একটি দল কাজ করছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের জরিপে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশে।
২০১৪ সালে ৪১ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশ মনে করতেন লেবার পার্টি সরকার পরিচালনা করতে সক্ষম। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের জরিপে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩১ শতাংশে।
এই জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইপসসের প্রধান নির্বাহী বেন পেইজ বলেছেন, কিয়ার স্টারমারের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা খুবই কম। এতটা কম তিনি কোনো বিরোধী দলের নেতার ক্ষেত্রে এর আগে কখনোই দেখেননি। তাঁর মতে, বেশির ভাগ মানুষ আসলে ক্ষমতাসীনদের পছন্দ করছেন না। তার মানে এই নয় যে তাঁরা লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে কী করবে সে বিষয়ে আগ্রহী।
বিষয়টা কি এমন হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে ব্রিটিশ জনগণ ক্ষমতায় লেবার পার্টিকে চায়। কিন্তু নেতৃত্বের প্রতি আস্থা কম? নাকি গত আট বছরে পাঁচ প্রধানমন্ত্রী দর্শন করা জনগণ কোনো রাজনৈতিক নেতাকেই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না?
আনুমানিক এই প্রশ্ন যতটা জটিল, উত্তর তার চেয়ে বেশি জটিল। ৪ জুলাইয়ের নির্বাচন থেকে যে উত্তর পাওয়া যাবে তাকেও চূড়ান্ত হিসেবে ধরে নেওয়ার সুযোগ এখনই থাকছে না। কারণ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে যিনি পরিকল্পনা করছেন, তাঁর জনপ্রিয়তার পরি যেকোনো সময় উড়ে গিয়ে তাঁর পদ আঁকড়ে থাকার বাস্তবতাকে কল্পনায় বদলে দিতে পারে। কারণ, নির্বাচনে জয়ই এখানে শেষ কথা নয়।
রিনভী তুষার লেখক ও গবেষক
ই-মেইল: [email protected]