বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ নিয়ে তুমুল আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। সরকারি সিদ্ধান্তে এই পেনশন স্কিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরসহ আরও বেশ কিছু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বলা হচ্ছে, এই বছর ১ জুলাই থেকে যাঁরা কাজে যোগদান করছেন, তাঁরা সবাই এই প্রত্যয় পেনশন স্কিমের আওতাভুক্ত হবেন। যদিও এই স্কিমের বিস্তারিত এখনো বিশদভাবে জানা সম্ভব হয়নি, তবে কিছু মূল বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে আজকের এই লেখা।
প্রত্যয় স্কিমের প্রথম যে বিষয় আলোচনার দাবি রাখে, তা হচ্ছে চাকরিজীবীদের পেনশন তহবিলে চাঁদার জোগান, অর্থাৎ প্রত্যয় স্কিমটি হচ্ছে একটি ফান্ডেড স্কিম। বলা হয়েছে, চাকরিজীবীরা তাঁদের বেতনের ১০ শতাংশ বা ৫ হাজার টাকা, এ দুয়ের মধ্যে যেটি কম তা প্রতি মাসে পেনশন তহবিলে চাঁদা হিসেবে জমা করবেন এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সমপরিমাণ টাকা ওই তহবিলে জমা করবেন (এখানে উল্লেখ্য, প্রত্যয় স্কিমে আরও কয়েক ধরনের চাঁদার উল্লেখ থাকলেও আমি এই লেখায় শুধু একধরনের চাঁদার উদাহরণ ব্যবহার করেছি)।
এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ, কেননা আনফান্ডেড পেনশন-ব্যবস্থা কখনোই দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হয় না। বিশেষত বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে আর্থিক খাত এখনো তেমন মজবুত নয়, সেখানে সরকারের পক্ষে দীর্ঘ মেয়াদে এই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে পেনশন-ব্যবস্থা রয়েছে, তার বেশি ভাগই ফান্ডেড পেনশন-ব্যবস্থা।
দ্বিতীয়ত, প্রত্যয় স্কিমে অবসর-পরবর্তী যে মাসিক ভাতার হিসাব দেওয়া হয়েছে, তার কোনো হিসাবপদ্ধতি বর্ণনা করা হয়নি। বলা হয়েছে, কেউ যদি প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে টানা ৩০ বছর চাঁদা প্রদান করেন, তবে অবসরের পরে প্রতি মাসে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা করে পাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার মাসিক ভাতা কীভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রচলিত সর্বনিম্ন পেনশন স্কিমের উদাহরণ বিবেচনায় এই ভাতা হওয়া উচিত ন্যূনতম ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি পদ্ধতি, যেমন সর্বশেষ বেতন বা গড় বেতন বিবেচনায় পেনশন ভাতা নির্ধারণ করা হয়, যার ফলে অবসর-পরবর্তী মাসিক পেনশন ভাতার পরিমাণের তারতম্য হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ও যৌক্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করে মাসিক ভাতা নির্ধারণ করা উচিত বলে মনে করি।
প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অবসর-পরবর্তী মাসিক পেনশন ভাতা পেনশন তহবিলের মোট জমার ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যয় স্কিমে সবার জন্য সমান পরিমাণ প্রাতিষ্ঠানিক চাঁদার হার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা কিনা চাকরিজীবীদের চাঁদার সমপরিমাণ। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক অবদানের কথা বিবেচনা করে উন্নত দেশগুলোসহ আরও অনেক দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষকদের পেনশন তহবিলে দুই থেকে তিন গুণ বেশি চাঁদা জমা করে।
পরিশেষে এ কথা বলা অপরিহার্য যে সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রধানমন্ত্রীর একটি সর্বজনীন অবদান। কিন্তু এর পরিকল্পনা ও প্রয়োগ অপরিপক্ব ও প্রশ্নবিদ্ধ। এই স্কিমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচিত ছিল এটি শুরুর আগে সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে সেবাগ্রহীতাদের জন্য উপযোগী করা। কিন্তু তা না করে তারা প্রকারান্তরে স্কিমটির সাফল্যের সম্ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
যেমন যুক্তরাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ইউনিভার্সিটি সুপার-অ্যানুয়েশন স্কিম রয়েছে, যেখানে প্রতি মাসে শিক্ষকেরা যে পরিমাণ চাঁদা দেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার দ্বিগুণ বা কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তিন গুণ পর্যন্ত মাসিক চাঁদা প্রদান করে।
অর্থাৎ একজন শিক্ষক যদি প্রতি মাসে তাঁর বেতনের ১০ শতাংশ পেনশন তহবিলে জমা করেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসে ন্যূনতম ২০ শতাংশ ওই তহবিলে জমা করবে। এর ফলে শিক্ষকদের অবসর-পরবর্তী মাসিক পেনশন ভাতাও বৃদ্ধি পাবে। আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অর্থনৈতিক অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের জন্য প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত চাঁদার হার বৃদ্ধির কথা সরকার চিন্তা করতে পারে।
তৃতীয়ত, প্রত্যয় স্কিমে অবসর-পরবর্তী মাসিক পেনশন ভাতা স্থির রাখা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে এই ভাতা ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতির কথা বিবেচনায় নিলে এটি অত্যন্ত অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির হার সাধারণত বেশ বেশি থাকে এবং এর ফলে প্রকৃত আয় দ্রুত হ্রাস পায়।
এই সমস্যা দূরীকরণে পেনশন ভাতা প্রতিবছর গড় মুদ্রাস্ফীতির হারে সমন্বয় করা প্রয়োজন। চাকরিজীবীরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড় মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে আরও ২ থেকে ৩ শতাংশ বেশি হারে এই সমন্বয় করা হয়ে থাকে। প্রত্যয় স্কিমেও এই সমন্বয় করা হবে বলে আমি আশাবাদী।
চতুর্থত, প্রত্যয় স্কিমে শুধু অবসর-পরবর্তী মাসিক ভাতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, কিন্তু কোনো এককালীন টাকার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এটি অবশ্যই একটি অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। একজন সরকারি চাকরিজীবী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চাকরিকালে যে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পান, তা দিয়ে দৈনন্দিন জীবনধারণের অতিরিক্ত ব্যয় কষ্টসাধ্য। সুতরাং একটি বড়সংখ্যক শিক্ষক বা চাকরিজীবী তাঁদের চাকরিজীবনে নিজের একটি বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারবেন না, এটাই স্বাভাবিক। ফলে অনেকেই অবসর-পরবর্তী এককালীন পাওনা ব্যবহার করে নিজের বাসস্থানের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন।
এ অবস্থায় এককালীন পাওনার ব্যবস্থা রহিত করা হলে তা মোটেই পেনশনভোগীর জন্য কল্যাণকর হবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত ফান্ডেড পেনশন-ব্যবস্থায় মোট জমাকৃত পেনশন তহবিলের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ এককালীন উত্তোলনের ব্যবস্থা থাকে এবং এটি হয় করমুক্ত। প্রত্যয় স্কিমেও এই সুযোগের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত জরুরি ও যুক্তিসংগত।
পঞ্চমত, প্রত্যয় স্কিমে প্রদেয় চাঁদার ওপর এবং অবসর-পরবর্তী সময়ে প্রাপ্য মাসিক ভাতার ওপরে কী পরিমাণ কর ধার্য করা হবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সাধারণত চাকরিকালে প্রদেয় মাসিক চাঁদা চাকরিজীবীর করযোগ্য আয়কে কমিয়ে দেয়।
ফলে এটি চাকরিজীবীকে কিছুটা করসুবিধা প্রদান করে। তা ছাড়া অবসর-পরবর্তী মাসিক ভাতা সাধারণত করমুক্ত হতে পারে বা করযোগ্য হলে তা সাধারণ কর হার থেকে অনেক কম হয়। প্রত্যয় স্কিম কর্তৃপক্ষের উচিত এই বিষয়গুলো পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করা।
ষষ্ঠত, পেনশন স্কিমের মাধ্যমে সংগৃহীত চাঁদা দীর্ঘ মেয়াদে একটি বিশাল তহবিলে রূপান্তরিত হয়। পেনশন স্কিমের সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে কীভাবে এই তহবিল ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। যদি এই তহবিল লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা না হয়, তবে ভবিষ্যতে অবসর গ্রহণকারী ব্যক্তির মাসিক পেনশন ভাতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
আমাদের দেশের বর্তমান আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রশ্নের সম্মুখীন। এ অবস্থায় পেনশন তহবিলের সফল ব্যবস্থাপনা কী করে হবে, তার একটি বিশদ ব্যাখ্যা আমরা আশা করতে পারি। তা ছাড়া পেনশন তহবিল ব্যবস্থাপনায় যেন সব স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ রক্ষা হয়, তার জন্য ব্যবস্থাপনা পর্ষদে সব স্টেকহোল্ডারের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ একান্ত অপরিহার্য।
পরিশেষে এ কথা বলা অপরিহার্য যে সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রধানমন্ত্রীর একটি সর্বজনীন অবদান। কিন্তু এর পরিকল্পনা ও প্রয়োগ অপরিপক্ব ও প্রশ্নবিদ্ধ। এই স্কিমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উচিত ছিল এটি শুরুর আগে সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে সেবাগ্রহীতাদের জন্য উপযোগী করা। কিন্তু তা না করে তারা প্রকারান্তরে স্কিমটির সাফল্যের সম্ভাবনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
সরকারের মনে রাখা উচিত যে অনেক ভালো উদ্যোগ মাঝেমধ্যে অতি উৎসাহী নীতিনির্ধারকদের অর্বাচীন কার্যক্রমের কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সুতরাং আমরা আশা করি, সরকার বা নীতিনির্ধারকেরা অতি দ্রুত সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনায় বসে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে প্রত্যয় স্কিমের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে তা সমুন্নত করার চেষ্টা করবে।
ড. মসফিক উদ্দিন, অধ্যাপক লিডস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য