জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত সপ্তম শ্রেণির বইগুলো আমাদের নজরে এসেছে। কৌতূহলবশত ‘যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কীভাবে’ অধ্যায়টি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। পড়ে আমি রীতিমতো মর্মাহত, বাক্রুদ্ধ ও হতাশ।
নতুন শিক্ষাক্রমের ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ের অষ্টম পৃষ্ঠায় ‘যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কীভাবে?’ (সূচিপত্রে শিরোনামের পরে প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকলেও মূল আলোচনায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেওয়া হয়নি।) অধ্যায়ের আলোচনা শুরু হয়েছে ‘আমাদের প্রথম পড়া দাঁতটি আমরা কী করেছি?’ শিরোনাম দিয়ে। সেখানে শুরুতেই একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি শিশু ঘুমিয়ে আছে, আর তার পাশে একটা পরি এসে দাঁত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এই ছবি দেখে যেকোনো পাঠকের মনে হবে, এটা দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য লেখা কোনো বই, যারা রূপকথার গল্প ভালোবাসে। ছবির নিচেই একটি অণুগল্প জুড়ে দেওয়া হয়েছে। গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে: ‘রুপা আজ ক্লাসে এসেছে কাগজে মোড়ানো একদম ছোট্ট একটা কিছু নিয়ে। সবাই বলল, কী এর ভেতরে? খুলে দেখাও।’ রুপা মোড়ানো কাগজ খুলতেই বেরিয়ে এল সাদা ছোট্ট একটি দাঁত’ (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ২০২৩, পৃষ্ঠা নম্বর ৮)। রুপা ক্লাসে দাঁত নিয়ে এসেছে দেখে ক্লাসের সবাই খুশি আপাকে জিজ্ঞেস করে, সত্যি পরি এসে দাঁত নিয়ে যায় কি না কিংবা ইঁদুর এসে সত্যি দাঁত নিয়ে যেতে পারে কি না। এ অধ্যায়ে মূলত প্রথম দাঁত পড়া নিয়ে সমাজে প্রচলিত গল্প বা সংস্কার নিয়ে গবেষণার ধারণা দিতে ছেলেমেয়েদের গবেষণার পদ্ধতির বিভিন্ন ধাপ শেখানো হয়েছে। সুতরাং প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতার হয়তো কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু অভাব ছিল চিন্তার পরিধির, পর্যাপ্ত গবেষণার এবং সঠিক তথ্যের। অর্থাৎ এককথায় গবেষণাপদ্ধতির শিক্ষা প্রণয়নে গবেষণার ঘাটতি ছিল যথেষ্ট। অন্যদিকে ‘যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কীভাবে’-এর শিক্ষা আদৌ যৌক্তিক কি না, সে বিষয়েও রয়েছে আমার সন্দেহ।
প্রথম কথা হলো, এই বই লেখা হয়েছে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য। ছয় বছরে পড়াশোনা শুরু করলে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীর বয়স হওয়ার কথা ১২ বছর। এ বয়সে একজন শিক্ষার্থী তার বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ করে এবং পৃথিবী অপার বিস্ময়ের দ্বার তার কাছে একটু একটু করে উন্মোচিত হতে থাকে; শারীরিক ও মানসিক গঠনের এক আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করে ভিন্নরূপে, সেখানে তাকে শেখানো হচ্ছে প্রাক্-প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুতোষ রূপকথার গল্পের রহস্য কীভাবে উন্মোচন করা যায়, সেই বিদ্যা।
প্রতিটি বইয়ের বিষয়বস্তু লেখার আগে সেটা কোন বয়সের শিক্ষার্থীর জন্য লেখা হচ্ছে, তা বিবেচনা করা খুব জরুরি। এই বয়সী একজন মেয়েশিক্ষার্থী অপর মেয়েশিক্ষার্থীর সঙ্গে পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা করে, তার শরীরের পরিবর্তন এবং সেই পরিবর্তনের সঙ্গে মানানসই পোশাক নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করে। একই সঙ্গে ছেলেশিক্ষার্থীদের মধ্যেও রয়েছে কিছু কৌতূহল। এই বয়সে তারা ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে চায়। বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। তারা গোয়েন্দাকাহিনি, ভ্রমণকাহিনি, সায়েন্স ফিকশন কিংবা রোমান্টিক উপন্যাস পড়ে, সিনেমা দেখে। অনেকে টুকটাক লেখালেখিও শুরু করে। এই গবেষণা হতে পারত একটি বাস্তবধর্মী কোনো বিষয়ে, যে বিষয়ে সে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। যেটা গবেষণাপদ্ধতি শেখার সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য নতুন জ্ঞান তৈরি করত।
পাঠ্যক্রম প্রণয়নের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও গবেষণার অভাবে তা একধরনের সংকট তৈরি করেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের আগে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু, শিক্ষার্থীদের বয়স, মনস্তত্ত্বের সঙ্গে তা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে বিষয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাড়াহুড়ো করে একটা ক্লাস থেকে এই নতুন শিক্ষাক্রম শুরু করা একধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এ গবেষণা সম্পন্ন করতে গিয়ে বিষয়বস্তুর বিভিন্ন স্থানে ‘পূর্বানুমান’, ‘আগের ধারণা’ এবং ‘অনুমান’ শব্দ তিনটিকে সমার্থক হিসেবে কিংবা একটি অন্যটির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। একজন দর্শনের ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবে আমি যতটা জানি, ‘পূর্বানুমান’, ‘ধারণা’ এবং ‘অনুমান’ এক বিষয় নয়। ‘পূর্বানুমান’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘hypothesis’ এবং ‘অনুমান’ শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘inference’। অন্যদিকে ধারণার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘idea’। পূর্বানুমান হলো একটি বাক্য, একটি গবেষণায় যার সত্যতা কিংবা মিথ্যাত্ব যাচাই করা হয়। অন্যদিকে অনুমান হলো একটি প্রক্রিয়া, যেখানে এক বা একাধিক আশ্রয়বাক্য থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় বা অনুমিত হয়। একটি অনুমানে সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসেবে একটি পূর্বানুমান ব্যবহৃত হতে পারে। তাই কোনো অবস্থাতেই ভুল করে হলেও কোনো একাডেমিক আলোচনায় কিংবা রিসার্চ মেথোডলজিতে পূর্বানুমানকে অনুমান বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের বিভিন্ন স্থানে, যেমন পৃষ্ঠা ১৫-তে পূর্বানুমানকে অনুমানের সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক সময় আবার পূর্বানুমানকে ‘আগের ধারণা বা অনুমান’ও(পৃষ্ঠা-১৬) বলা হয়েছে। অন্যদিকে ধারণা খুবই ব্যক্তিগত; কারণ, ধারণা হলো mental representational image of objects বা বস্তুর মনস্তাত্ত্বিক রিপ্রেজেন্টেশনাল প্রতিবিম্ব, যা একান্তই ব্যক্তিগত। যেমন আমার মনে যে দ্বীপের ধারণা, তা অন্যের মনের দ্বীপের থেকে আলাদা হতে পারে। সুতরাং অনুমান, পূর্বের ধারণা আর পূর্বানুমান কোনো অবস্থাতেই সমার্থক নয় এবং এদের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করা দূষণীয়।
তৃতীয়ত, যাকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলা হচ্ছে, সেটাতে আসলেই কোনো যৌক্তিক পদ্ধতি ব্যবহারের আলোচনা করা হয়েছে কি? যৌক্তিক পদ্ধতি দুই রকম হয়—আরোহ ও অবরোহ। আরোহের সিদ্ধান্ত সম্ভাব্য অন্যদিকে অবরোহের সিদ্ধান্তগুলো নিশ্চয়তা প্রদান করে। যুক্তি আরোহ বা অবরোহ যা-ই হোক না কেন, তাতে এক বা একাধিক আশ্রয়বাক্য থাকবে এবং সেই আশ্রয়বাক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। একটা অবরোহ যুক্তির ক্ষেত্রে যদি সব আশ্রয়বাক্য সত্য হয়, তবে সিদ্ধান্তও অবশ্যই সত্য হবে। যেমন যদি ‘পৃথিবীর সব মানুষ মরণশীল’ এবং ‘সক্রেটিস একজন মানুষ’ বাক্য দুটি সত্য হয়, তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে ‘সক্রেটিস মরণশীল’। এ ক্ষেত্রে ‘সক্রেটিস মরণশীল’ বাক্যের মিথ্যা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আমাদের আশ্রয়বাক্য দুটিই সত্য। অন্যদিকে ‘সক্রেটিস মরণশীল’, ‘প্লেটো মরণশীল’, ‘অ্যারিস্টটল মরণশীল’ সত্যি হলে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে ‘সম্ভবত সব মানুষ মরণশীল’। ওই পাঠে যেহেতু যৌক্তিক সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে, সেহেতু কোন ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটা উল্লেখ করা উচিত ছিল। অর্থাৎ এখানে পরিমাণগত গবেষণাপদ্ধতির বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করা হলেও একে বলা হয়েছে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি, যেখানে যুক্তির আলোচনাই বাদ পড়েছে। ফলে শিক্ষার্থীর শিক্ষা অপূর্ণাঙ্গ ও অসম্পূর্ণ রয়ে যাচ্ছে।
চতুর্থত, গল্পটি যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, এটি যেন কোনো শিশুতোষ গল্পের বই। এ ধরনের গল্প প্রাক্-প্রাথমিক কিংবা প্রাথমিকের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েদের জন্য একেবারে বেমানান। অন্যদিকে গবেষণাপদ্ধতির মতো উঁচু স্তরের বিষয়বস্তু সপ্তম শ্রেণির জন্য একেবারে অপ্রয়োজনীয়। গবেষণাপদ্ধতি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার আগে বিবেচনা করা উচিত ছিল প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার উদ্দেশ্য কী এবং তা কোন বয়সী শিক্ষার্থীর জন্য প্রযোজ্য। ফলে একদিকে যেমন বিষয়বস্তু হিসেবে গবেষণাপদ্ধতির মতো অতি উচ্চমার্গের বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, অন্যদিকে গল্পগুলো লেখা হয়েছে শিশুতোষ বইয়ের আদলে। ফলে উভয় দিক থেকেই অধ্যায়টি ভারসাম্যহীন।
বস্তুত এই পাঠ্যক্রম প্রণয়নের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও গবেষণার অভাবে তা একধরনের সংকট তৈরি করেছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের আগে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু, শিক্ষার্থীদের বয়স, মনস্তত্ত্বের সঙ্গে তা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে বিষয়ে আরও গবেষণা করা প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তাড়াহুড়ো করে একটা ক্লাস থেকে এই নতুন শিক্ষাক্রম শুরু করা একধরনের বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে।
হয়তো যিনি বা যাঁরা এভাবে বিষয়বস্তু তৈরির পরিকল্পনা করেছেন, তাঁদের মাথায় ছিল ছেলেমেয়েদের ওপর থেকে পড়াশোনার চাপ কমানো। অতিরিক্ত চাপ কমাতে গিয়ে একদিকে যেমন চাপ আরও বাড়ানো হয়েছে অন্যদিকে তাদের নির্ভার করে দেওয়া হয়েছে। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা জরুরি, অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান দিতে না পারলে অপুষ্টিতে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। একটি জাতির সঠিক উন্নয়নের জন্য তেমনি বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার জোগান দিতে হবে। এ ধরনের ভারসাম্যহীন বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীর সঠিক মেধার বিকাশকে ব্যাহত করবে। তাই আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, এই পাঠ্যক্রম অবিলম্বে বাদ দেওয়া হোক। এমন ভুলে ভরা, অসম্পূর্ণ ও অপূর্ণাঙ্গ পাঠ্যক্রম থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মুক্তি পাক।
নাসরীন সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও, কানাডা
ই-মেইল: [email protected]