যাত্রাপথে এমন দৃশ্য কেউ দেখতে চায় না। কাঁচপুর ব্রিজে উঠে তাই দেখতে হলো। দুর্ঘটনাটি মাত্রই ঘটেছে। একটি মাইক্রোবাস ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার মধ্যে সংঘর্ষ। দুটোই দুমড়ে–মুচড়ে গেছে। পেছনের সব গাড়ি আটকে আছে। উল্টো পাশ দিয়ে যেসব গাড়ি সেতু পার হচ্ছিল, সেগুলোর গতিও স্লো হয়ে গেছে। কেউ কেউ গাড়ি থামিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছিলেন।
আমাদের গাড়িও অল্প সময়ের জন্য থেমে গিয়েছিল। না চাইলেও তাকাতে হলো। আশপাশের লোকজন ভেতর থেকে হতাহতদের বের করার চেষ্টা করছেন। সেতুর ডিভাইডারের কাছে একজনকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তাঁর প্রাণ আছে বলে মনে হলো না। এমন একটি দৃশ্যকে পেছনে রেখেই আমাদের এগোতে হলো।
দুর্ঘটনার ধরন দেখে আমাদের চালক বললেন, ‘ব্যাটারির রিকশাটি মনে হয় উল্টা যাচ্ছিল, না হইলে এমন হওয়ার কথা না।’ মন থেকে ভয়াবহ এই দৃশ্য সরাতে চাইলাম। কিন্তু পারা গেল না। গন্তব্যে পৌঁছে ঘণ্টা দুয়েক পর প্রথম আলোর অনলাইন খুলেই পেলাম সেই দুর্ঘটনার বিস্তারিত খবর। শিরোনাম: ‘উল্টো পথের অটোরিকশার সঙ্গে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত’।
ঘটনাটি ঘটেছে গত রোববার, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)–এর ছুটির দিনে। গতকাল সোমবার পত্রিকা বের না হওয়ায় প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার পাঠকেরা খবরটি পাননি। পাঠকদের জন্য খবরটির মূল অংশটি তুলে ধরছি।
‘প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকা থেকে ছয়জন যাত্রী নিয়ে অটোরিকশাটি উল্টো পথে কাঁচপুর সেতু পার হচ্ছিল। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা ঢাকাগামী মাইক্রোবাসের সঙ্গে অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে অটোরিকশাটি দুমড়েমুচড়ে যায় ও মাইক্রোবাসের সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘটনাস্থলেই অটোরিকশার যাত্রী নুরুউদ্দিন মিয়া মারা যান। গুরুতর অবস্থায় অটোরিকশার চালকসহ চারজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহত চারজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গুরুতর আহত অটোরিকশাচালক হানিফ এবং অন্য তিন যাত্রী মামুন, জামাল হোসেন ও অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।’
দুর্ঘটনাটির পরিণতি এতটা ভয়াবহ হবে, তা ভাবতে পারিনি। পাঁচটি জীবন এত সহজে ‘খরচ’ হয়ে গেল!
আইনের শাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প তৈরির ব্যাপার নেই। মাত্রা ছাড়া খরচ করে সড়ক বা সেতু বানানো বা দফায় দফায় প্রকল্পের খরচ বাড়ানো ও সেই সূত্রে ভাগ-বাঁটোয়ারার সুযোগও নেই। এমন কাজে কার আগ্রহ থাকবে? সরকারের ‘একমাত্রিক উন্নয়ন–দর্শনের’ পেছনের ‘দর্শনটি’ আসলে কী তা আমরা ধারণা করতে পারি।
আমরা প্রশ্ন করতে পারি, একটি সেতুতে উল্টো পথে যানবাহন কীভাবে চলে? এটা দেখার দায়িত্ব কার? এই মৃত্যুর দায় কে নেবে? হাইওয়ে পুলিশ? স্থানীয় প্রশাসন? যোগাযোগ বা সেতু মন্ত্রণালয়? নাকি সামগ্রিকভাবে সরকার? আসলে এসব প্রশ্ন করা অর্থহীন। এর জবাব দেওয়ার কেউ নেই, কারও দায়ও নেই। কারণ, জবাবদিহিহীনভাবেই এখন সবকিছু চলছে।
এমন মৃত্যু আমাদের কাছে এখন আর সংখ্যা ছাড়া কিছুই নয়। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী গত মাসে, মানে সেপ্টেম্বরে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৪৭৬ জনের। এই মাসের এ রকম পরিসংখ্যানে নিছক একটি সংখ্যা হিসেবে এই ‘৫’ যুক্ত হবে। প্রতি মাসেই এমন হিসাব পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে কার কী আসে যায়!
আসলেই যে কিছুই আসে যায় না, তার প্রমাণ মিলল সন্ধ্যায় সেই পথে ফেরার সময়। আগে থেকেই ভাবছিলাম, খেয়াল করে দেখব কাঁচপুর সেতুতে উল্টো পথে কোনো বাহন চলতে দেখি কি না। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, ব্যাটারিচালিত কয়েকটি অটোরিকশা আমাদের গাড়ির পাশ দিয়ে দিব্যি উল্টো পথে সেতু পার হচ্ছে। যেন সকালে কিছুই হয়নি। সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন বা হাইওয়ে পুলিশ কতটা নির্বিকার হলে এমনটি ঘটতে পারে! সকালে পাঁচটি মৃত্যুর পরও পরিস্থিতির সামান্য রদবদল হয় না! সাময়িক হলেও কোনো তোড়জোড় দেখা যায় না!
দুর্ঘটনা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু কাঁচপুর ব্রিজের ঘটনাটিকে তো দুর্ঘটনা বলা যাচ্ছে না। উল্টো পথে যান চলতে দিয়ে বা এই বেআইনি কাজ বন্ধ করতে না পারার কারণেই ঘটনাটি ঘটেছে। এখানে দায়িত্বে অবহেলা ও ব্যর্থতার দিক আছে। পাঁচটি প্রাণের এভাবে চলে যাওয়া তাই দুর্ঘটনা নয়, ‘অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড’। কিন্তু বিচারের বাইরেই থেকে যায় এসব ‘হত্যাকাণ্ড’।
এটাই এখন রেওয়াজ। অবস্থা এমন হয়েছে যে রাষ্ট্র-সরকার-প্রশাসন এসব নামের সব থাকলেও দেশের মানুষের প্রতি যে তাদের কোনো দায় আছে তা টের পাওয়া যায় না। তারা ‘উন্নয়ন’ নিয়ে মেতেছে, সেখানে মানুষ বা জনগণ যেন বাদ পড়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘উন্নয়ন’ কার জন্য ও কিসের জন্য?
উন্নয়ন মানে কি শুধু সড়ক আর সেতু বানানো? বড় বড় অবকাঠামো তৈরি করা? নাকি উন্নয়ন বিষয়টি আরও বড়? সেতু তৈরি হলো, সড়ক তৈরি হলো কিন্তু ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন হলো না, অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে সেই সেতু ও সড়কে মানুষ মারা পড়তে থাকল, সেই উন্নয়ন কেমন উন্নয়ন! সড়কে যদি উল্টো পথে ট্রাক-বাস চলে, নিয়ম না মেনে যদি যেখানে-সেখানে যানবাহন থামে, মহাসড়কে বাজার বসার কারণে যদি যানজটে আটকে থাকতে হয় এবং এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা যদি আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সংশ্লিষ্টদের না থাকে, তবে কেন আমরা এসব বানাচ্ছি?
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম গত জুনে। তিনি সরকারের বর্তমান ‘উন্নয়ন’ বয়ানের সমস্যার দিক তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘উন্নয়নের একমাত্রিক দর্শনে আমরা বাংলাদেশকে আটকে ফেলেছি। উন্নয়ন বলতে আমরা বৃহৎ অবকাঠামোকে ধরে নিয়েছি।’
কোনো উন্নয়ন যদি ‘একমাত্রিক’ হয়, তবে তা বহুমাত্রিক ফল দেবে না এটাই স্বাভাবিক। ‘একমাত্রিক উন্নয়ন দর্শনের’ কারণেই মনোযোগ শুধু একদিকে। সড়ক বা সেতু—এসব বানানোর পাশাপাশি সড়ক ব্যবস্থাপনারও যে ‘উন্নয়ন’ করতে হবে, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, সেই দিকে তাই কারও মনোযোগ নেই।
কেন নেই, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। হিসাব খুব সহজ। ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন বা আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হয় জবাবদিহির মাধ্যমে।
আইনের শাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে। এখানে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প তৈরির ব্যাপার নেই। মাত্রা ছাড়া খরচ করে সড়ক বা সেতু বানানো বা দফায় দফায় প্রকল্পের খরচ বাড়ানো ও সেই সূত্রে ভাগ-বাঁটোয়ারার সুযোগও নেই। এমন কাজে কার আগ্রহ থাকবে? সরকারের ‘একমাত্রিক উন্নয়ন–দর্শনের’ পেছনের ‘দর্শনটি’ আসলে কী তা আমরা ধারণা করতে পারি।
সরকারের উন্নয়ন–দর্শনের পেছনের দর্শনে যদি মানুষ বা জনগণের চেয়ে ভিন্ন কিছু প্রাধান্য পায়, তাহলে এমন মৃত্যু ঘটতেই থাকবে। এসব মৃত্যু ঠেকানোর কোনো উদ্যোগও আমরা দেখব না। রাষ্ট্র, সরকার বা প্রশাসন—এসব থাকার পরও কেউই এমন মৃত্যুর দায় নেবে না। কাউকে এর জন্য জবাবদিহিও করতে হবে না।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক