৭ জানুয়ারিতে কী ঘটবে? শৈত্যপ্রবাহ নাকি সত্যপ্রবাহ

আমরা অপেক্ষা করছিলাম দেশে সত্যপ্রবাহ বইবে। কান খাঁড়া করে ছিলাম।
অনেকেই ‘সত্য’ উচ্চারণ করতে পারেন না। তাঁরা বলেন, ‘সইত্য’।‘সত্যপ্রবাহ’কে তাঁরা উচ্চারণ করেন ‘সইত্যপ্রবাহ’ বলে। তখন কোনটা ‘সত্যপ্রবাহ’ আর কোনটা ‘শৈত্যপ্রবাহ’, আলাদা করা যায় না।

৭ জানুয়ারি কী হবে, তা নিয়ে আগে সত্যপ্রবাহ শোনা যাক:
৭ জানুয়ারিতে আকাশ থাকবে রৌদ্রালোকিত। একটু একটু কুয়াশা থাকবে ঢাকার আকাশে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকবে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তবে ফিল লাইক তাপমাত্রা হবে ২৬ ডিগ্রি। রাতে তাপমাত্রা কমে ১৬ ডিগ্রিতে নামবে, তবে অনুভব হবে ১৪ ডিগ্রি। আকাশে কোনো মেঘ থাকবে না।
অতিবেগুনি রশ্মি ৪। মধ্যমানের। ঝড়বৃষ্টি হবে না। বাতাসের গতিবেগ ৯ কিলোমিটার/ঘণ্টা। ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
সূর্যোদয় ৬টা ৪২ মিনিটে। সূর্যাস্ত ৫টা ২৭ মিনিটে। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঠবে রাত ২টা ২৪ মিনিটে।

আরও পড়ুন

চায়নিজ রেস্তোরাঁগুলো খোলা থাকবে। বাংলাদেশি স্টাইলের চীনা খাওয়া আগের মতোই বিক্রি হবে এবং বাংলাদেশের খাদ্যরসিকেরা তা আগের মতোই খেতে থাকবেন।

ভারতীয় কুইজিন আগের মতোই চলবে। উত্তর ভারতের নানরুটি, চিকেন তন্দুরি, ম্যাঙ্গো লাসসা, দক্ষিণ ভারতীয় ইডলি বা দোসার বিক্রি থাকবে যথারীতি।

নিরামিষভোজীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা সব রেস্তোরাঁতেই আগের মতো থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

আমেরিকান বার্গারও ঠিকঠাকভাবে বিক্রি হবে। আমেরিকান খাবারের দোকানগুলোয় বার্গার, পিৎজা, ফ্রায়েড চিকেন ছাড়াও আলুর চিপস ভালো বিক্রি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাশিয়ান খাবারের খ্যাতি বাংলাদেশে নেই। তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকার হাটবাজারগুলোয় রাশিয়ান পণ্যের বিক্রি থাকবে স্বাভাবিক।
পাকিস্তানি মোরগ বাংলাদেশের খাদ্যরসিকদের মধ্যে আগের মতোই জনপ্রিয় থাকবে। ভারতীয় গরমমসলার সঙ্গে বাংলাদেশি গুঁড়া মসলা মিশিয়ে পাকিস্তানি কক গ্রিল করা হবে।

৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামারস ডে। সেই হিসাবে প্রোগ্রামাররা এই দিনে ব্যস্ত থাকবেন।

আরও পড়ুন

টেলিভিশনে বাংলাদেশের মানুষেরা যথারীতি ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল, হিন্দি সিরিয়াল এবং টক শো দেখবেন। খেলার চ্যানেলগুলো খেলা দেখিয়ে যাবে। তবে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো কেমন করবে, তা আগে থেকে বলা যাচ্ছে না।

ইন্টারনেট কানেকশন স্লো থাকার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে টিকটকার, ইউটিউবার, ইনফ্লুয়েনসাররা হয়তো একটা অলস ছুটির দিন কাটাতে পারেন।

উত্তরাঞ্চলগুলোয় তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। ৪ জানুয়ারি এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত তেঁতুলিয়ায় ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এই রকম তীব্র শীতে মানুষ কষ্ট পেতে থাকবে বলেই শঙ্কা করা যাচ্ছে।

‘শীতকালে শীত না পড়লে চলে’ বলে অনেকেই তাঁদের বিশেষ শীতের কাপড়গুলো পরার জন্য বের করবেন। তবে বিয়ের অনুষ্ঠান, বউভাতের অনুষ্ঠান যা থাকবে ৭ জানুয়ারিতে, তাতে শৈত্যপ্রবাহ খানিকটা বাধা তৈরি করতে পারে। লেহেঙ্গা ইত্যাদির সঙ্গে চাদর ইত্যাদি পরাটা আবার শোভন হয় না। তখন হিন্দি ছবিতে তুষারের মধ্যে শাহরুখ খান ওভারকোট পরা, আর কাজল যথাসম্ভব গ্রীষ্মকালের পোশাক পরা—এই রকম কন্ট্রাস্ট তৈরি হতে পারে।

প্রিয় পাঠক, আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটানোর জন্য দুঃখিত।

আমরা সবাই চাই সত্যপ্রবাহ আসুক। শৈত্যপ্রবাহে বাংলাদেশের মানুষ, উত্তরাঞ্চলের গরিব মানুষ, ঢাকার রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা শিশুরা যেন কষ্ট না পায়।

এই দেশে সাড়ে তিন কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের ভাঙা ঘরে শীতের কনকনে বাতাস হু হু করে ঢুকে পড়ে। ছেঁড়া কাঁথা সেই শীতের কামড় ঠেকাতে পারে না। তারা সারা রাত খড়কুটো জ্বেলে তার পাশে বসে শীতের বিরুদ্ধে লড়াই করে। আমরা তাই বলতে পারি না, শীতের দিনে শীত না পড়লে চলে!

একটা করে কম্বল দিয়ে যে এই শীত থেকে মানুষ বাঁচানো যায় না, আমরা তা জানি। কারণ, মানুষ আসলে শীতে মরে না, গরমে মরে না, মানুষ মারা যায় দারিদ্র্যে। এই দেশে মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৬১৯ ডলার। মানে প্রতি মাসে ২০০ ডলারের বেশি। মানে প্রতি মাসে ২৪ হাজার টাকার বেশি। কুড়িগ্রামের একটা চরে যদি একটা পরিবারে চারজন সদস্য থাকে, তাদের গড় আয় মাসে এক লাখ টাকা।

তাহলে তারা শীতে মারা যায় কেন? মঙ্গায় কষ্ট পায় কেন? হিসাব সহজ! বৈষম্য। আমরা কোটিপতি উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ড করেছি।

ওয়েল, কাম টু দ্য পয়েন্ট। দুই দিন পর দেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের কবিতা দিয়ে শেষ করি:
হে সূর্য, তুমি তো জানো,
আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব!
সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে,
এক-টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে,
কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই!
...
হে সূর্য
তুমি আমাদের উত্তাপ দিও
শুনেছি, তুমি এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড,
তোমার কাছে উত্তাপ পেয়ে পেয়ে
একদিন হয়তো আমরা প্রত্যেকেই এক একটা জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডে
পরিণত হব!
তারপর সেই উত্তাপে যখন পুড়বে আমাদের জড়তা,
তখন হয়তো গরম কাপড়ে ঢেকে দিতে পারবো
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।
আজ কিন্তু আমরা তোমার অকৃপণ উত্তাপের প্রার্থী।।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক