আমাদের লুটেরা তঞ্চকদের খাঁই মেটে না কেন? এরা আর কত খেতে চায়? এই আবদুল হাইয়েরা, লুৎফর রহমান রিটনের ছড়ার আবদুল হাইয়ের মতো, সব সময় খাই খাই করছে।
‘আবদুল হাই,
করে খাই খাই,
এক্ষুনি খেয়ে বলে
কিছু খাই নাই।
‘গরু খায় খাসি খায়
টাটকা ও বাসি খায়
আম খায়
জাম খায়
টিভি প্রোগ্রাম খায়।’
একটা মানুষের জীবনে আসলে কত টাকা দরকার হয়! কত টাকা কেজি দরের কতটা চাল একজন মানুষ এক মাসে খেতে পারে? মানুষ যত ধনী হয়, তাকে তো তত কম খেতে দেখি। অনেক বড় রাজপ্রাসাদে থাকতে পারেন একজন ধনবান, কিন্তু তাঁর থাকার জন্য কয়টা বাড়ি লাগে! প্রাইভেট জেট লাগে? কয়টা? এই চাওয়ার কি কোনো শেষ আছে? পাওয়ার কি কোনো শেষ আছে?
একটা বিষয় আছে, যাঁরা শিল্প-কলকারখানা গড়েন, যাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, তাঁরা তাঁদের ব্যবসা প্রতিবছর বড় থেকে আরও বড় করার চেষ্টা করেন। এই ক্ষুধাটা তাঁদের থাকে। থাকে বলেই তাঁদের বার্ষিক আয়-ব্যয় বাড়ে, কিন্তু তার দ্বারা ব্যবসা বা কারখানা বড় হয়, বিস্তৃত হয়, তাতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়, দেশের অর্থনীতি দৃঢ় হয়, দেশের এবং পৃথিবীর উপকার হয়।
কিন্তু লুটপাটের, দুর্নীতির, তস্করবৃত্তির, দস্যুবৃত্তির ফলে তো কেবল ক্ষতিই হয় দেশের, মানুষের, সভ্যতার। এই লুটের টাকার কোনো আয়কর নেই। এই চুরির টাকা সাধারণত দেশে রাখা হয় না। বিদেশে পাচার করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এই লুটতন্ত্র-পাচারতন্ত্র চলতে দেওয়া হচ্ছে কেন! কেন হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে পালিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে পি কে হালদারদের! কেন কানাডায়, আমেরিকায়, মালয়েশিয়ায়, আরব আমিরাতে বেগমপাড়া গড়ে উঠছে দেদার! কেন পানামায় টাকা যাচ্ছে! কেন টাকা ভরা হচ্ছে আর তোলা হচ্ছে সুইস ব্যাংকে! কেন বিদেশে ডলার পাচারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকে শীর্ষস্থানে! পানামার মতো দেশগুলোতে টাকা রাখা হচ্ছে কেন! কারা রাখছেন?
যে যেভাবে পারছে, লুটে নিচ্ছে, শুষে নিচ্ছে। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝাড়ুদার নিয়োগ দিতেও ঘুষ আদান-প্রদান হয়! নিয়োগ পরীক্ষার, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহ করে বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে! পার্টির ইউনিয়ন কমিটি গড়াপেটার কাজেও চলে টাকা আদান-প্রদান। আমাদের সড়ক নির্মাণের খরচ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। শত শত সেতু বানানো শুরু হয়েছে, কাজ আর শেষ হয়নি, সেতুগুলো পড়ে আছে অর্ধসমাপ্ত, প্রায় সমাপ্ত; কিন্তু কোনো কাজে লাগছে না।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সারাক্ষণ পরিশ্রম করছেন, একটিবারও থামছেন না, থামলে এই দেশের ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেত। কাতারে, দুবাইয়ে মগজগলা তাপে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ডলার পাঠায় গরিব মানুষেরা, সেই টাকা লুট করে আমরা নেতাগিরি করি, সুশীলগিরি ফলাই, সাদা মাড়ভাঙা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে হাত উঁচিয়ে উপদেশ দিই! এত অবিচারে ভরা এই কায়েমি ব্যবস্থা! এসব দেখেশুনে নিয়তিবাদী হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখি না।
কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভবন বানানো হয়েছে, এমনি এমনি পড়ে আছে, কেন বানানো হয়েছে, লোকে ভুলেও গেছে। আমাদের শুধু মেগা প্রকল্পে উৎসাহ। কারণ, তাতে এক কোপে বড় দাঁওটা মারা যায়। ভূমিখেকো, নদীখেকো, বনখেকো, মেগা প্রকল্পখেকো, ব্যাংকখেকো...চারদিকে রাক্ষসেরা রূপকথার বোতল থেকে বেরিয়ে হাউ-মাউ-খাউ করছে! হাউ-মাউ-খাউ, টাকার গন্ধ পাউ। খাউ, খাউ, খাউ।
কিন্তু কেউ দেখেও দেখছে না। এসব দেখি কানার হাটবাজার! সবাই সবকিছু জানে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। কেউ কিছু করে না।
তবু দেশটা যে চলছে, তার পেছনে আছে দেশের মানুষের প্রচণ্ড পরিশ্রম, আর আশ্চর্য সৃজনশীলতা। একজন মাছের পোনা বিক্রি করতে হাঁড়িতে নিয়ে ট্রেনের ছাদে উঠেছেন, সারাক্ষণ পানিটা তাকে নাড়তে হচ্ছে, এভাবেই ট্রেন থেকে নেমে ভ্যানে চড়ে তিনি হাটে যাচ্ছেন, পানি নাড়ছেন, হাটে গিয়েও পানি নাড়তে নাড়তেই তিনি বিক্রি করছেন পোনা। ওই মানুষটা তার হাত দিয়ে পানি নাড়া কখনো বন্ধ করেন না। কারণ, পানিতে অক্সিজেন জোগাতে হচ্ছে তাকে, তা না হলে মাছের পোনা মারা পড়বে।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সারাক্ষণ পরিশ্রম করছেন, একটিবারও থামছেন না, থামলে এই দেশের ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেত। কাতারে, দুবাইয়ে মগজগলা তাপে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে ডলার পাঠায় গরিব মানুষেরা, সেই টাকা লুট করে আমরা নেতাগিরি করি, সুশীলগিরি ফলাই, সাদা মাড়ভাঙা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে হাত উঁচিয়ে উপদেশ দিই! এত অবিচারে ভরা এই কায়েমি ব্যবস্থা! এসব দেখেশুনে নিয়তিবাদী হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখি না।
তলস্তয়ের এই গল্পটা অনেকেরই জানা। হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ আ ম্যান নিড—একজন মানুষের কত বেশি জমি দরকার! গল্পের নায়ক পাহম। কৃষিকাজ করে। ভালো আয় হয়। ভালোই ছিল। তার আরও জমি দরকার। সে আরও ভালো থাকতে চায়। সে জায়গা বদল করে। আরেক জায়গায় যায়। এখানে জমি সস্তা। সে অনেক জমির মালিক হয়।
তারপর তার সঙ্গে দেখা হয় বাশকির গোত্রের একজনের সঙ্গে। সেই বাশকির তাঁকে প্রস্তাব দেয়, মাত্র এক হাজার রুবল দিতে হবে। পাহম সকালবেলা একটা কোদাল হাতে রওনা দেবে। যত দূর পর্যন্ত ইচ্ছা যাবে, কোদাল দিয়ে জমিতে চিহ্ন দেবে, আর সূর্য ডোবার আগেই সকালের জায়গায় তাকে ফিরে আসতে হবে। তাহলেই পুরো জমি পাহমের হয়ে যাবে।
নির্ধারিত দিনে পাহম রওনা হলো সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। জমি, আরও জমি। সে ছুটছে। একসময় তার মনে হলো, ফিরতে হবে। আবার সে ছুটছে। কিন্তু সে বড় বেশি দূরে চলে গিয়েছিল। তাই তাকে ফিরতে হচ্ছে বেশি জোরে। সূর্য ডোবার আগেই ফিরতে পারল পাহম। তবে নিশানার কাছে আসতে না আসতেই লুটিয়ে পড়ল তার দেহ। সে মারা গেল। তখন পাহমকে ৬ ফুট দীর্ঘ সমাধিতে নামানো হলো। সমাধিক্ষেত্রটাও ছিল সাধারণ, নাম না-জানা। কতটা জমি একজন মানুষের দরকার হয়? উত্তর পাওয়া গেল, সাড়ে তিন হাত।
হাদিস শরিফে আছে, ‘যদি বনি আদমের স্বর্ণভরা একটি উপত্যকা থাকে, তথাপি সে তার জন্য দু’টি উপত্যকা কামনা করবে। তার মুখ মাটি ব্যতীত অন্য কিছুতেই ভরবে না।’ ( বুখারি শরিফ, ৬৪৩৯)
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আছে:
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
কাজী নজরুল ইসলামদের রক্তলেখায় মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে খাওয়া রাক্ষসদের সর্বনাশ কবে রচিত হবে!
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক