বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদকে নিয়ে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনার মূল কারণ অবশ্য ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পাওয়া নিয়ে। ফ্যান্টাসি নয়, তিনি বাস্তবেই এমন চেরাগ হাতে পেয়েছিলেন! সেই চেরাগ থেকে দৈত্য বের হয়েছিল কি না, সেটা অবশ্য জানা যায়নি। তবে তিনি অর্থ–সম্পদে যে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বেনজীর তা কীভাবে হলেন, কখন হলেন, তা জানার আগেই উড়াল দিলেন তিনি। সঙ্গে করে কী কী নিয়ে গিয়েছেন; সেটা অবশ্য জানা যায়নি। এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ভেতরে-ভেতরে এমন আরও কত মানুষ বেনজীর হয়ে উঠেছে– কারও কি তা জানা আছে? এর চাইতেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সামনে কি দৃষ্টান্তটা রেখে গেলেন পুলিশের এই সাবেক মহাপরিদর্শক?
বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশে বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের আগ্রহ অনেক বেড়ে গেছে। এর মধ্যে প্রশাসন বা পুলিশ ক্যাডারের প্রতি আগ্রহ বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরিগুলোতে শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়া বাদ দিয়ে বিসিএস গাইড নিয়ে বসে থাকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে দিন কয়েক আগে শুনতে পাচ্ছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাকি লাইব্রেরিতে বসে বিসিএস গাইড পড়া বন্ধ করে দিতে পারে। সত্যি সত্যি বাদ দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটা ভিন্ন আলোচনা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একাডেমিক পড়াশোনার প্রতি ছাত্র-ছাত্রীরা যে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, এটা বোধকরি কারও অজানা নয়।
বেশ কয়েক বছর আগে আমি কুষ্টিয়ায় একটা গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে। তখন আমি দেশের একটা নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি, সেই বাড়ির কর্তা আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘তুমি কী করো?’ বললাম, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি।’ এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘এটা কি সরকারি চাকরি?’ বললাম, ‘না, এটা সরকারি চাকরি নয়।’ তিনি এরপর খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘তুমি সরকারি চাকরি পাওনি?’
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের কোনোভাবেই একাডেমিক পড়াশোনায় আগ্রহী করে তুলতে পারছে না। এ থেকে বোঝা যায়, একাডেমিক পড়াশোনার সঙ্গে চাকরির পরীক্ষার যেমন বিস্তর ফারাক রয়েছে। ঠিক তেমনি একাডেমিক পড়াশোনা হয়তো বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খুব একটা বাস্তবসম্মতও নয়। এ জন্য বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা নিজেদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে চাকরির পড়াশোনা কিংবা অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে কীভাবে তারা একাডেমিক পড়াশোনা আরও বাস্তবসম্মত করবে। যাতে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনায় আগ্রহ ফিরে পায়। জোর করে তো আর ছেলে-মেয়েদের বিসিএস পড়াশোনা বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
এটা তো বাস্তব, ছেলে-মেয়েরা নিজেদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিসিএস নিয়ে পড়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এত আগ্রহ? এর একটা কারণ হচ্ছে, তারা দেখতে পাচ্ছে, সমাজে সরকারি বড় কর্তারাই ক্ষমতাবান এবং অর্থবিত্তের মালিক; অর্থাৎ একবার সরকারি বড় কর্তা হয়ে গেলে সবাই সমীহ করে চলে। একটা উদাহরণ বরং দেওয়া যাক।
বেশ কয়েক বছর আগে আমি কুষ্টিয়ায় একটা গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে। তখন আমি দেশের একটা নামকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। যে বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি, সেই বাড়ির কর্তা আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘তুমি কী করো?’ বললাম, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি।’ এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘এটা কি সরকারি চাকরি?’ বললাম, ‘না, এটা সরকারি চাকরি নয়।’ তিনি এরপর খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, ‘তুমি সরকারি চাকরি পাওনি?’
অর্থাৎ তিনি ধরেই নিয়েছেন সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য কোনো চাকরি ভালো চাকরি নয়! অথচ আমি সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টাই করিনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন উনার এমন মানসিকতা হলো?
কারণ, তিনি নিশ্চয় দেখতে পেয়েছেন আশপাশের যাঁরা অর্থবান এবং ক্ষমতাবান; তাঁদের বেশির ভাগই সরকারি চাকরি করছেন। নিজেদের এলাকায় তাঁদের একটা প্রভাবও হয়তো আছে। এ জন্য হয়তো সমাজের মানুষের মানসিকতাও সেভাবেই গড়ে উঠছে। ঠিক যেমনটা পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীরের বেলায় হয়েছে। নিজ এলাকায় তিনি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। তাঁর একটা প্রভাব ছিল। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তাঁর মতো হয়ে চেয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তারা বেনজীরের মতো হতে চায়?
মানুষের মনের ইচ্ছা তো আর চাইলেই জানা সম্ভব নয়। তবে এটা তো অস্বীকার করা যাবে না, দিন কয়েক আগেও অনেকের আদর্শ ছিলেন পুলিশের সাবেক কর্তা জনাব বেনজীর।
তাদের কেউই কি জানত না, তিনি এসব করে বেড়াচ্ছেন? পুলিশের ভেতরেও কি কেউ জানতেন না? কিংবা অন্য কেউ? কে জানে, হয়তো অনেকেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ বানানোটাকেই আদর্শ বানিয়ে ফেলেছেন! ভুলে গেলে চলবে না, এই বেনজীর কিন্তু শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছেন। সেই সঙ্গে সেরা করদাতা এবং শুদ্ধাচার পুরস্কারও পেয়েছেন। কারা তাঁকে এই পুরস্কার দিয়েছেন? তাঁদের ভূমিকা আসলে কী?
ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি ই-মেইল: [email protected]