ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে যেভাবে সবচেয়ে বেশি ফায়দা তুলছে নরওয়ে

আহত এক সহকর্মীকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন ইউক্রেনীয় সেনারাছবি: এএফপি

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনে আক্রমণ করেন, তখন হয়তো তিনি ভাবতেই পারেননি, তাঁর এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে নরওয়ে। 

যুদ্ধ শুরুর পর দেখা গেল, ইউরোপে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস রপ্তানি কমে গেছে এবং নরওয়ে রাতারাতি ইউরোপের সবচেয়ে বড় জ্বালানি সরবরাহকারী দেশে পরিণত হয়েছে। 

যুদ্ধের কারণে তেল ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় নরওয়ে এখন বিপুল পরিমাণ আয় করছে। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ ও ২০২৩ সালে শুধু গ্যাস রপ্তানি থেকেই দেশটি ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ক্রোনারের (১১১ বিলিয়ন ডলার) বেশি আয় করেছে। 

প্রশ্ন উঠছে, এত অর্থ আয়ের পরও নরওয়ে কেন ২০২৫ সালের বাজেটে ইউক্রেনকে সহায়তা করার জন্য মাত্র ৩ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের সামান্য কিছু বেশি বরাদ্দ করেছে? 

২০২৪ সালের সহায়তা যোগ করলেও এই বরাদ্দ দুই বছরে নরওয়ের প্রাপ্ত যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত আয়ের ৫ শতাংশের কম হবে। তুলনার দিক থেকে বলা যায়, ইউরোপের সবচেয়ে বড় দাতা জার্মানি ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ইউক্রেনকে সামরিক, আর্থিক ও মানবিক সহায়তা হিসেবে ১৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এই সময়ে ৯২ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। অথচ নরওয়ের এই দুই বছরের অতিরিক্ত আয় জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার মোট পরিমাণের চেয়ে বেশি। 

জিডিপির ভিত্তিতে নরওয়ের ইউক্রেন সহায়তার হার মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, যা কিনা ইউরোপে নবম স্থানে আছে। অর্থাৎ নরওয়ের ইউক্রেন সহায়তা ডেনমার্কের ২ শতাংশ এবং এস্তোনিয়ার ২ দশমিক ২ শতাংশ সহায়তার তুলনায় অনেক কম। 

নরওয়ে চাইলে যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারত। দেশটি যুদ্ধপরবর্তী ইউক্রেন পুনর্গঠনেও অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারত। অথচ তাদের এ বিষয়ে নৈতিক দায়িত্বও রয়েছে। কারণ, জ্বালানি বেচে তাদের যে অতিরিক্ত আয় হয়েছে, তা সরাসরি রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে হয়েছে। তাই এই আয়ের একটা বড় অংশ তাদের পাওয়া উচিত, যারা ফ্রন্টলাইনে যুদ্ধ করে নিজেদের দেশকে স্বাধীন রাখার জন্য জীবন দিচ্ছে। 

কিন্তু নরওয়ের সরকার এই আয়ের বেশির ভাগই নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এটি তাদের যুদ্ধের মুনাফাখোর হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করছে। দেশটির বিরোধী দলগুলো অবশ্য ইউক্রেনের জন্য আরও বেশি সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে এবং সরকারের প্রাথমিক বাজেটের চেয়ে কিছুটা বেশি সহায়তা দিতে বাধ্য করেছে। তবে কোনো দলই যুদ্ধের পুরো অতিরিক্ত আয় ইউক্রেনকে দেওয়ার কথা প্রস্তাব করেনি।

এ বিষয়ে নরওয়ের সরকারের অবস্থান বিভ্রান্তিকর। কারণ, দেশটি রাশিয়ার সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করছে এবং দীর্ঘ সময় ধরে দেশটি তার নিরাপত্তা রক্ষায় মিত্রদের সাহায্যের ওপর নির্ভর করেছে। যদি রাশিয়া এই যুদ্ধে জেতে বা তাদের পক্ষে কোনো শান্তিচুক্তি হয়, তবে নরওয়ের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। 

নরওয়ে ইউক্রেনকে তার অতিরিক্ত আয় দিয়ে দিলে নরওয়ে যে আর্থিক সংকটে পড়বে, এমনও নয়। এই অতিরিক্ত আয় তার সার্বভৌম তহবিলের ৬ শতাংশের মতো, যা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে বড় তহবিল। এর মোট মূল্য ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। 

নরওয়ে প্রতিবছর তেলের ও গ্যাসের আয় তার তহবিলের মধ্যে রাখে এবং ওই তহবিলের মোট মূল্যের ৩ শতাংশের বেশি সরকারি বাজেটে ব্যবহার করা যায় না। এই নিয়মটি মুদ্রাস্ফীতি এবং মুদ্রার মানের ওপর প্রভাব কমায় এবং তহবিলটিকে স্থিতিশীল রাখে। 

তবে, নরওয়ের যে নিয়ম অনুযায়ী তারা তাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যবহার করে, তা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য তৈরি হয়নি। তাই এটি ইউক্রেনকে বেশি সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা হতে পারে না। এই অর্থ নরওয়ের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হবে না। তাই এর কারণে মুদ্রাস্ফীতি বা অন্য কোনো অর্থনৈতিক সমস্যা হবে না। 

নরওয়ে যে এই প্রথম তার অতিরিক্ত আয় জমিয়ে রাখার বিষয়ে আলোচনা করেছে, তা নয়। তবে এবারই প্রথম সরকারিভাবে এই অতিরিক্ত আয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। 

অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাক্‌-যুদ্ধ সময়ের গ্যাসমূল্য অনুযায়ী অতিরিক্ত আয় হিসাব করেছে। যদিও এই হিসাব কিছুটা অনুমাননির্ভর, তবে এটি নরওয়ের যুদ্ধকালীন অতিরিক্ত আয়ের আনুমানিক পরিমাণ জানার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়।

প্রকৃত আয়ের পরিমাণ হয়তো আরও বেশি। কারণ, তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে অতিরিক্ত আয় হয়েছে, তা এই হিসাবের মধ্যে নেই। 

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ফিরে আসার পর যেসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে, তা নিয়ে ইউরোপীয়রা চিন্তা করছে। এমন পরিস্থিতিতে নরওয়ের সরকারের উচিত ইউক্রেনকে তাদের অতিরিক্ত আয় সহায়তা হিসেবে দিয়ে দেওয়া। 

হাভার্ড হল্যান্ড বর্তমানে হেরিয়ট-ওয়াট ইউনিভার্সিটির সাসটেইনেবল ফাইন্যান্সের অধ্যাপক ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ এবং 

নুট আন্তোন মর্ক নরওয়ের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ