সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ ধর্মীয় উৎসবগুলোর অন্যতম শ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেন দারুব্রহ্ম জগন্নাথরূপে পুরীধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন, এর ব্যাখ্যা পুরাণে আছে। বহুকাল আগে ভারতের অবন্তীনগরে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামের বিষ্ণুভক্ত এক রাজা ছিলেন। ওডিশার নীলগিরি পর্বতে অবস্থিত ভগবান শ্রীনীলমাধবের সেবা করার তাঁর প্রবল ইচ্ছা। কিন্তু রাজা নীলগিরিতে পৌঁছানোর আগেই নীলমাধব অন্তর্হিত হয়ে যান।
ভগবানের দর্শন না পেয়ে বিষণ্ন রাজা প্রাসাদে ফিরে আসেন এবং ভগবানের দ্বারা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি একদিন সমুদ্রে তিনটি কাঠের গুঁড়ি খুঁজে পান। সেগুলো থেকে বিগ্রহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং দেবতাদের স্থপতি বিশ্বকর্মার ছদ্মবেশে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নর কাছে আসেন। তিনি রাজাকে নির্দেশ দেন ২১ দিনের জন্য তাঁকে একটি নির্জন ঘর ছেড়ে দিতে। বিশ্বকর্মা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, যদি ২১ দিনের আগে দরজা খোলা হয়, তাহলে বিগ্রহ নির্মাণের কাজ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
১৫ দিন অতিবাহিত হয়ে যায়, কিন্তু গৃহের ভেতর থেকে খোদাইকাজের কোনো রকম শব্দ শোনা যায় না। গুণ্ডিচা মহারানি সন্দেহ করেন, ১৫ দিন কোনো রকম খাদ্য না খাওয়ার জন্য হয়তো বৃদ্ধ সূত্রকার মারা গেছেন। তিনি রাজাকে দরজাটি খোলার নির্দেশ দিলেন এবং তদন্ত করতে বললেন। রাজা এই প্রস্তাবে সহমত হলেন না, তিনি সূত্রকারের নির্দেশ অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহারানির কারণে বাধ্য হয়ে অনিচ্ছাপূর্বক তিনি দরজাটি খুললেন। তিনি লক্ষ করলেন, সূত্রকার অদৃশ্য হয়ে গেছেন এবং বিগ্রহগুলো অসম্পূর্ণ অবস্থায় আছে। তখন রাজা একই সঙ্গে হতাশ ও আতঙ্কিত হলেন।
তখন একটি দৈববাণী শোনা গেল, ‘চিন্তা কোরো না, ইন্দ্রদ্যুম্ন। তুমি ২১ দিনের আগেই দরজাটি খুলে দিয়েছ এবং তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছ। তাই বিগ্রহগণ এ রূপেই থাকবেন। কিন্তু তুমি তাঁদের সেবা-পূজা শুরু করতে পারো। ব্রহ্মলোক থেকে ব্রহ্মাকে আহ্বান করে তাঁদের প্রতিষ্ঠা করো।’
এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, এই বিগ্রহগণ ভগবানের অসম্পূর্ণ ও অসমাপ্ত রূপ। অনেকে বলেন, পরমব্রহ্ম হলেন নিরাকার, ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের এই ‘অসম্পূর্ণ’ আকার তা প্রমাণ করে। অনেকে বলেন, এটি ভগবান বুদ্ধের একটি আকার। তা ছাড়া অনেকে এই আকার ভৈরবের বলেও দাবি করেন। অনেক মানুষের কাছে এই রূপ খুব ভয়ানক বলে মনে হয়। কিন্তু অনেকে তাঁর এই সুন্দর রূপের গুণকীর্তন করেন; বিশেষ করে শ্রীজগন্নাথদেবের হাস্যবদন। এসব দাবি যথাযথ। কারণ, শ্রীজগন্নাথদেব হলেন সবকিছু।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্ত নারদ মুনির অভীষ্ট পূরণের জন্য পুনরায় শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে তাঁর এই বিশেষ রূপ প্রকটিত করেন এবং চিন্ময়রূপে সেখানে এখনো তিনি বিরাজ করছেন। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব তাঁর অপলক নেত্রে জগদ্বাসীকে দর্শনদানের জন্য রথে চড়ে রাজপথে বেরিয়ে আসেন।
এভাবে তাঁদের এই রূপ প্রকটিত হওয়ার পেছনে একটি গূঢ় কারণ আছে। আসলে ভগবান জগন্নাথদেব, বলদেব ও সুভদ্রার এই আকার কিন্তু বিকৃত বা অসম্পূর্ণ নয়; বরং তাঁরা পরমেশ্বর ভগবানের পরম, দিব্যপূর্ণ প্রকাশ। ভগবানের এই রূপ এমন হওয়ার কারণ এটি ছিল না যে রানি মহারাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে অকালে দরজাটি খুলতে বাধ্য করেছিলেন সে জন্য। আসলে ভগবান আগেই ভক্তদের সামনে তাঁর এই সুদর্শন রূপ প্রকটিত করেছিলেন।
তাঁদের অনুরোধে, চকা-ডোলা ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব (ওডিশায় ‘চকা-ডোলা’ মানে যার চোখগুলো খুব প্রশস্ত) সারা বিশ্বকে উদ্ধার করার জন্য দয়াপরবশ হয়ে প্রত্যেককে তাঁর দর্শন দেন। বৈষ্ণবেরা তা উপলব্ধি করতে পারেন এবং তাঁরা ভগবান ও তাঁর ভক্তদের মধ্যে যে প্রেমময় আদান-প্রদান হয়, তা মহিমান্বিত করেন। তাঁরা ভগবান শ্রীজগন্নাথের এই রূপে আবির্ভাবের লীলা আস্বাদন করেন।
মথুরা থেকে গমনের পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ১৬ হাজার ১০৮ জন মহিষীর সঙ্গে দ্বারকায় বাস করতেন। মহিষীরা ভগবানকে প্রগাঢ় প্রেম ও যত্নের সঙ্গে সেবা করতেন। যদিও এই রানিরা তাঁদের দেবোপম পতির পরিতৃপ্তির জন্য সর্বদা একনিষ্ঠভাবে সেবারত থাকতেন, তবু শ্রীকৃষ্ণ সর্বদা বৃন্দাবনের কথা চিন্তা করতেন।
তিনি সর্বদা তাঁর প্রিয় ব্রজবাসীদের স্মরণ করতেন, বিশেষ করে গোপ ও গোপীদের এবং তীব্র আকাঙ্ক্ষা সঙ্গে তিনি তাঁদের দ্বারা ঘটিত লীলা স্মরণ করতেন। কখনো কখনো বৃন্দাবনের বিরহে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সবকিছুতে কেমন একটা উদাসীন হয়ে যেতেন। মহিষীরা ভাবতেন, ‘যদিও আমরা আমাদের প্রভুকে এত ভালোভাবে সেবা করছি, তবু কেন তিনি সর্বদা বৃন্দাবনের কথা বলছেন এবং চিন্তন করছেন?’ বাস্তবিকই ভগবান তাঁর নিদ্রার মধ্যে বারবার ‘রাধে রাধে! গোপী! গোপী!’ বলে ক্রন্দন করতেন।
ফলে রানিরা ভগবানের বৃন্দাবনলীলা জানার জন্য কৌতূহল প্রকাশ করলেন। ‘সেখানে কী এমন ঘটেছিল যে ভগবান তা ভুলতে পারছেন না? কিন্তু ভগবানের বৃন্দাবনের শৈশবলীলার কথা কে আমাদের বলতে পারবে? রানিরা এরূপ চিন্তা করলেন। দেবকী ও বসুদেব সেখানে ছিলেন না যে তাঁদের জিজ্ঞাসা করা যাবে। পরিশেষে তাঁরা জানতে পারলেন, রোহিণী মাতা ভগবানের বৃন্দাবনলীলার প্রত্যক্ষদর্শী।’
ভাগ্যচক্রে রোহিণী মাতা তখন দ্বারকাতেই অবস্থান করছিলেন। একদিন সব রানি উদ্বেলিতভাবে তাঁর কাছে যান এবং কৃপাপূর্বক তাঁকে ভগবানের বৃন্দাবনলীলা বর্ণনা করার জন্য অনুরোধ করেন।
রোহিণী মাতা উপলব্ধি করলেন, ভগবানের ব্রজলীলা শ্রবণ করার জন্য রানিরা খুব উদ্গ্রীব হয়ে আছেন। তিনি বললেন, ‘শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা এতটাই মধুর যে কৃষ্ণ নিজেও তা শ্রবণ করার জন্য আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আমি সেই অপরূপ ক্রিয়াকলাপ তোমাদের বর্ণনা করতে পারি, কিন্তু একটা শর্ত আছে। আমি যে লীলা বর্ণনা করব, তা যেন কৃষ্ণ আর বলরাম শুনতে না পায়। যদি তারা শ্রবণ করে, তাহলে মহাসমস্যা তৈরি হবে।’
একদিন কৃষ্ণ ও বলরাম সুধর্মাকক্ষে একটি আলোচনা সভায় যোগদান করতে গিয়েছিলেন। রানিরা তাঁদের অনুপস্থিতির সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আগ্রহের সঙ্গে সবাই মিলে রোহিণী মাতার কাছে সমবেত হলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের শৈশবলীলা বর্ণনার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলেন। রোহিণী মাতা সুভদ্রাকে দ্বাররক্ষিণীর দায়িত্ব দিলেন, যাতে তাঁর ভ্রাতারা লীলা শ্রবণ করতে না পারেন। যদি কৃষ্ণ ও বলরাম সেখানে আসেন, তাহলে সুভদ্রা তাঁকে সংকেত দেবেন।
সবকিছু প্রস্তুত। রানিরা তীব্র উৎকণ্ঠার সঙ্গে সমবেত হলেন। সুভদ্রা তাঁর বাহু প্রসারিত করে দ্বারের সামনে দাঁড়ালেন, যাতে কোনো ব্যক্তি, বিশেষ করে তাঁর ভ্রাতারা প্রবেশ করতে না পারেন। রোহিণী মাতা বৃন্দাবনে কৃষ্ণ ও বলরামের শৈশবলীলা বর্ণনা শুরু করলেন। তাঁর বর্ণনা এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে দ্বারকার সমস্ত রানি গভীর মনোযোগের সঙ্গে তা শ্রবণ করছিলেন। তাঁরা রোহিণী মাতার মুখনিঃসৃত অমৃত সুধা পান করার জন্য এতটাই নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলেন যে সবাই বাহ্যিক চেতনা হারালেন।
সুভদ্রা যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বাররক্ষিণীরূপে নিযুক্ত ছিলেন, কিন্তু ভগবান কৃষ্ণের লীলা শ্রবণের সুযোগ তিনিও হাতছাড়া করেননি। দ্বারকার রানিদের মতো আকর্ষণীয় বর্ণনা শ্রবণ করে তিনিও তাঁর বাহ্য সচেতনতা হারান। যদিও কৃষ্ণ ও বলরাম তখন সুধর্মাকক্ষে একটি আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারলেন, রোহিণী মাতা তাঁদের বৃন্দাবনলীলা বর্ণনা করছেন। লীলা শ্রবণের প্রবল বাসনায় দুই ভ্রাতা তৎক্ষণাৎ আলোচনা সভা ত্যাগ করে রোহিণী ও রানিরা যেখানে সমবেত হয়েছিলেন, সেই স্থানের প্রতি ধাবিত হলেন।
যখন তাঁরা দ্বারের সামনে পৌঁছালেন, তাঁরা দেখলেন, সুভদ্রা দ্বাররক্ষিণীরূপে দাঁড়িয়ে আছেন। কৃষ্ণ ও বলরাম সুভদ্রার দুই পাশে দাঁড়ালেন আর তৎক্ষণাৎ তাঁরা রোহিণী মাতার বর্ণনা শ্রবণে নিমগ্ন হয়ে গেলেন। যেহেতু সুভদ্রা সম্পূর্ণরূপে শ্রবণে নিমগ্ন ছিলেন, তিনি বাহ্যিক চেতনারহিত ছিলেন; তাই তিনি ভগবান কৃষ্ণ ও বলরামের উপস্থিতি টের পেলেন না।
লীলাকথা বর্ণনার প্রতি তাঁরা তিনজন এতটাই আহ্লাদিত হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁদের দেহের প্রবল বিকৃতি শুরু হয়। ‘এ কী অদ্ভুত লীলা! ব্রজবাসীদের অপরিসীম প্রেম ও ভালোবাসা।’ বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাঁদের চক্ষু বিস্ফারিত ও বৃহদাকার ধারণ করে। যে রকমভাবে কূর্ম তার হাত-পা দেহের অভ্যন্তরে অপসরণ করে, সেভাবেই তাঁদের হাত-পা দেহের অভ্যন্তরে অন্তর্হিত হলো।
সে সময় নারদ মুনি আবির্ভূত হন। বহুদূর থেকে তিনি কৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রার এই স্বরূপ দর্শন করেন। যখন তিনি তাঁদের কাছে আসেন, কৃষ্ণ তাঁর ভ্রাতা ও ভগিনীর সঙ্গে আবার বাহ্যচেতনায় আসেন। তাঁদের দেহ আবার পূর্বাবস্থায় স্বাভাবিক রূপে পরিবর্তিত হয়। তাঁরা মহাভাবের রূপ অপসৃত করেন, যা তাঁদের বিশেষ রূপ অভিব্যক্ত করেছিল।
নারদ মুনি আনন্দে নৃত্য-কীর্তন শুরু করেন। ‘আমি দর্শন করেছি, আমি দর্শন করেছি! আপনারা আমার কাছে লুকানোর চেষ্টা করছেন। হে প্রভু, আমি আপনার বহু রূপ দর্শন করেছি, কিন্তু আমি এই সুন্দর রূপ কখনো দর্শন করিনি। আমার বিনীত প্রার্থনা, কৃপাপূর্বক আপনার এই মহামঙ্গলকারী রূপ কোথাও অভিব্যক্ত করুন, যাতে প্রত্যেকে আপনার এই সবিশেষ মহাভাব প্রকাশ রূপের দর্শন করতে পারে।’
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্ত নারদ মুনির অভীষ্ট পূরণের জন্য পুনরায় শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে তাঁর এই বিশেষ রূপ প্রকটিত করেন এবং চিন্ময়রূপে সেখানে এখনো তিনি বিরাজ করছেন। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব তাঁর অপলক নেত্রে জগদ্বাসীকে দর্শনদানের জন্য রথে চড়ে রাজপথে বেরিয়ে আসেন।
জগতের নাথ জগন্নাথের রথযাত্রা ভারতে ওডিশার পুরীতে বিশেষভাবে উদ্যাপিত হলেও এখন এর পরিসীমা জগৎজুড়ে পরিব্যাপ্ত। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) প্রতিষ্ঠাতা আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এই রথযাত্রার বিশ্বায়ন ঘটিয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাসহ পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরে রথযাত্রা আড়ম্বরের সঙ্গে উদ্যাপিত হয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বিশ্বজুড়ে এক সম্প্রীতির উৎসব এই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা।
চারু চন্দ্র দাশ
সাধারণ সম্পাদক, ইসকন, বাংলাদেশ