১৯৯০ সালের কথা। মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তখনকার গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে নিয়ে যাওয়ার পথে ৫০ লাখ টাকা ছিনতাই হয়। ওই টাকা উদ্ধার ও ছিনতাইকারীদের ধরতে পুলিশ যখন হয়রান, তখনই কল্যাণপুরে ছিনতাইকারীরা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যদের কাছ থেকে দুটি স্টেনগান ছিনতাই করে। সেই টাকা উদ্ধারের অভিযানে যিনি নেতৃত্ব দেন, তাঁরই লেখায় উঠে এসেছে সাজানো কাহিনি দিয়ে পুলিশ কীভাবে স্টেনগান দুটি উদ্ধার দেখিয়েছিল।
প্রায় ৩০ বছর পুলিশের বিভিন্ন পদে চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা এক পুলিশের ডায়েরি বইয়ে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) সাবেক পরিচালক সফিকউল্লাহ যা লিখেছেন, তাতে পুলিশের সরকারি ভাষ্য আর আসলে কী ঘটে, তার অদ্ভুত নজির মেলে। ২০০২ সালে পুলিশ থেকে অবসরে যাওয়ার পর বর্তমান সরকারের শুরুর দিকে প্রায় পাঁচ বছর তিনি এনএসআই ও গোয়েন্দা বিভাগে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন।
বইটির সপ্তম অধ্যায়ে সফিকউল্লাহ লিখেছেন, ‘এমন সময়ে মনে পড়ে শুক্রাবাদের লতিফের কথা। ’৮৮ সালে কমিশনার প্রার্থী ছিলেন তিনি। সেই সময়ে নির্বাচনের জন্য বরিশালের সর্বহারাদের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকায় লতিফ একটি স্টেনগান কিনেছিলেন বলে আমার কাছে তথ্য ছিল। স্টেনগানসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। ব্যাপারটিও লতিফের জানা ছিল। তাই সে সব সময় সাবধানে চলাফেরা করত।
এবার আমি সরাসরি তাকে আমার অফিসে ডেকে এনে বলি যে তোমার কাছে একটা স্টেনগান আছে। তুমি কীভাবে জোগাড় করেছ, তা-ও আমার জানা আছে। তোমার ভাগ্য ভালো যে স্টেনগানসহ তুমি ধরা পড়োনি। তুমি যদি সত্যিকার অর্থে স্টেনগানসহ ধরা পড়ে জেলে যেতে না চাও, তাহলে স্টেনগানটি আমাকে দিয়ে দাও। তোমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করব না। উল্টো তুমি যে ৬০ হাজার টাকায় স্টেনগান কিনেছ, তোমাকে তা দিয়ে দেব।’
বলার অপেক্ষা রাখে না, শুক্রাবাদের লতিফ তাঁর অবৈধ অস্ত্রটি পুলিশকে দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন। দ্বিতীয় স্টেনগানটি সফিকউল্লাহ জোগাড় করেন জিগাতলা-রায়েরবাজার এলাকার তখনকার কমিশনার আহমেদ হোসেন মিয়ার (প্রকৃত নাম আমজাদ হোসেন মিয়া) কাছ থেকে। মিয়া যে স্টেনগান এনে দেন, সেটি সাভারে একটি নির্বাচনের জন্য জোগাড় করা ছিল বলে তাঁর ভাষ্য।
এর পরের নাটকটুকুও সফিকউল্লাহর কথাতেই জেনে নিই, ‘আর সংগ্রহ করা স্টেনগান দুটি উদ্ধার দেখানোর ব্যবস্থা করতে বলি রুনুকে (পুলিশেরই কোনো সদস্য)। উদ্ধার দেখানোর জন্য তিনি স্টেনগান দুটির গায়ে লেখা নম্বরগুলো মুছে ফেলেন। এরপর একটা চালাকি করে সে। আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিস এলাকায় ছিনতাইকারীকে ধাওয়া দিচ্ছে—এমন মনগড়া গল্প বলতে থাকে ওয়্যারলেসে। একপর্যায়ে ওয়্যারলেসে জানায়, ছিনতাইকারীরা একটি স্টেনগান ফেলে পালিয়ে গেছে। নাটকীয় আয়োজন করে স্টেনগান উদ্ধার দেখানো হয়। পরদিন খিলক্ষেত এলাকা থেকে একইভাবে উদ্ধার দেখানো হয় আরেকটা।’
দুঃখজনক হলেও সত্যি, চলতি বছরের পদকেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এবার পুরস্কৃত করা হয়েছে নির্দিষ্টভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের জন্য। প্যারেড গ্রাউন্ডের সৌন্দর্যবর্ধন এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পুলিশের গোপন নথি সংকলন করে প্রকাশের জন্য দুটি পদক বাদ দিলে বাকিগুলোর অধিকাংশই দেওয়া হয়েছে বিরোধী দলকে দমনে সাফল্যের জন্য। নিউ এজ পত্রিকা পদকপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের জন্য যেসব সম্মাননাপত্র তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে বিষয়টির কতটা রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হয়েছে
বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শুনলেই আমার এক পুলিশের ডায়েরির কথা মনে পড়ে। বইটিতে আরও অনেক ঘটনা আছে, যেগুলো থেকে পুলিশের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্ক কিংবা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কী ধরনের যোগাযোগ ঘটে, তার কিছুটা ধারণা মেলে। তবে সবচেয়ে বেশি যে ভাবনা বিচলিত করে তোলে, তা হলো দলীয় আনুগত্যের কারণে যদি এ রকম নাটক সাজানো হয়, তাহলে অবস্থাটা কেমন হতে পারে।
প্রতিবছরের মতো এবারও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হয়ে গেল পুলিশ সপ্তাহ। বছরে এই একটি অনুষ্ঠান পুলিশ খুবই আড়ম্বরের সঙ্গে পালন করে থাকে। আগের বছরের কাজের স্বীকৃতির জন্য পুলিশের নানা স্তরের কর্মকর্তা ও সদস্যদের পদক দেওয়া হয়। এবারও সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলামূলক আচরণের জন্য পুলিশ ও র্যাবের মোট ১১৭ জনকে ‘বিপিএম’, ‘পিপিএম’, ‘বিপিএম সেবা’ ও ‘পিপিএম সেবা’ পদক দেওয়া হয়েছে। পদকপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের তালিকা এবং কাকে, কেন, কোন পদক দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামায়নি।
টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মাদক নিয়ন্ত্রণের নামে একের পর এক প্রায় দেড় শ ‘বন্দুকযুদ্ধের কৃতিত্বের’ জন্য পুলিশের সর্বোচ্চ পদক পেয়েছিলেন ২০১৯ সালে। হত্যা মামলায় তাঁর দণ্ড হওয়ার পর পুলিশের পদক তালিকার বিষয়টি নিশ্চয়ই আলোচনার দাবি রাখে। এই দণ্ডাদেশ বলছে, পুলিশের পদকের মাপকাঠি ঠিক করার প্রচলিত ব্যবস্থার একটা সামগ্রিক পর্যালোচনা ও সংস্কারের প্রয়োজন।
২০১৯ সালে পুলিশ সপ্তাহ পালিত হয়েছিল ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এবং সেবার প্রায় ৪০০ জন পেয়েছিলেন পুলিশের পদক। যাঁরা পদক পেয়েছিলেন, তাঁদের কৃতিত্বের যেসব বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, এর মধ্যে আছে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন ও কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ, কথিত ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণামূলক’ সাক্ষাৎকারের জন্য (আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে) গ্রেপ্তারে ‘পেশাগত দক্ষতা’র স্বীকৃতি, ডিজিটাল মাধ্যমে কথিত অপপ্রচার বন্ধে সাফল্য ইত্যাদি।
তখন ‘ভিন্নমত ও প্রতিবাদ দমনের পদক’ শিরোনামে আমি লিখেছিলাম, ‘প্রতিবাদ-বিক্ষোভের বৈধ নাগরিক অধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও দমন-পীড়নের স্বীকৃতি দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদক দেওয়ার ঘটনা এক নতুন দৃষ্টান্ত। দৃশ্যত এর উদ্দেশ্য: ১. পুলিশকে দমনমূলক নীতি অনুসরণে উৎসাহ দেওয়া; ২. সরকারবিরোধী সব দল, গোষ্ঠী ও ব্যক্তির মধ্যে ভীতি ছড়ানো, যাতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলন দানা বাঁধতে না পারে।’
দুঃখজনক হলেও সত্যি, চলতি বছরের পদকেও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এবার পুরস্কৃত করা হয়েছে নির্দিষ্টভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের জন্য। প্যারেড গ্রাউন্ডের সৌন্দর্যবর্ধন এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পুলিশের গোপন নথি সংকলন করে প্রকাশের জন্য দুটি পদক বাদ দিলে বাকিগুলোর অধিকাংশই দেওয়া হয়েছে বিরোধী দলকে দমনে সাফল্যের জন্য। নিউ এজ পত্রিকা পদকপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যদের জন্য যেসব সম্মাননাপত্র তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে বিষয়টির কতটা রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হয়েছে (পুলিশ অফিসার্স অ্যাওয়ার্ডেড ফর ফয়েলিং অপজিশন র্যালিজ, ৫ জানুয়ারি ২০২৩)।
১০ ডিসেম্বর ঘিরে পুলিশ রাজধানীতে তিন দিন ধরে যে অবস্থা তৈরি করেছিল, তাতে নিশ্চয়ই তারা বীরত্বের স্বীকৃতি চাইতে পারে! পুলিশের আধুনিকায়নে যুক্ত হয়েছে হেলিকপ্টার। তবে সে হেলিকপ্টার জঙ্গি ছিনতাইয়ের সময় তাদের তাড়া করতে আকাশে ওড়েনি, বরং বিএনপির মহাসমাবেশের ওপরে তা গর্জন করেছে।
এখন গত সপ্তাহের দুটি খবরের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব। উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে গ্রেপ্তার হয়ে এক মাস দুই দিন জেল খাটার পর সদ্য মুক্তি পাওয়া বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনির বলেছিলেন, মহাসচিবের ড্রয়ারে দুই লাখ টাকা এবং তাঁর কার্যালয়ে ককটেল পাওয়া গেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসেছে যে তাঁরা পরিকল্পনাকারী ও উসকানিদাতা, যা আসামি চালানপত্রে (ফরোয়ার্ডিং লেটারে) উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের মির্জা ফখরুলের কক্ষ থেকে ককটেল এবং একই কার্যালয়ের মির্জা ফখরুল ও মির্জা আব্বাসের কক্ষ থেকে চার হাজার কেজি চাল ও ডাল, দুই লাখ টাকা উদ্ধার করা হয় বলে জানান এস এম মুনির। দেশের অন্যতম প্রধান দলের মহাসচিব নিজের কার্যালয়ে ককটেল রাখেন—এমন কাহিনির জন্য পুলিশের সৃজনশীলতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে, তা আমাদের মাথায় আসে না।
অন্য খবরটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘পিএম আস্কস পুলিশ টু রিট্যালিয়েট ইফ অ্যাটাকড’ (নিউ এজ, ৪ জানুয়ারি ২০২৩)। দেশের প্রচলিত আইনে আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার বিধান আছে জানি, কিন্তু প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো আইন খুঁজে পাচ্ছি না।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক