রাতারাতি বদলে গেছে বাংলাদেশ। স্বৈরাচার হিসেবে জনতার রোষে যঁাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো, এক মাস আগেও তাঁর পরিবর্তন সম্ভব, এমন ভাবনা আমাদের মাথায় ঢোকেনি। শুধু যে ক্ষমতার প্রতিটি ক্ষেত্রে এই স্বৈরাচার তাঁর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলেন তা–ই নয়, আমাদের চিন্তার রাজ্যেও তাঁর আধিপত্য ছিল প্রায় নিরঙ্কুশ।
ইতিহাস সাক্ষী, সবচেয়ে ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যও অনন্তকাল ক্ষমতায় টিকে থাকে না। ক্ষমতার দম্ভ ও সব বিরোধিতা দমনে সাফল্য শুধু যে ঔদ্ধত্যের জন্ম দেয় তা–ই নয়, শাসককে অন্ধ করে ফেলে। এখানে এত দীর্ঘ সময় নির্মম দক্ষতায় তাঁরা যে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন, তার অন্যতম কারণ একটি তাঁবেদার ক্ষমতাভোগী গোষ্ঠীর নিঃশর্ত সমর্থন। এই ক্ষমতাভোগীদের মধ্যে রয়েছে প্রশাসনের সদস্য, পেশাদার রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য অংশ।
আমরা যা পারিনি, তারা সেটা করে দেখিয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের সবার দায়িত্ব তাদের সে স্বপ্নযাত্রায় সমর্থন দেওয়া, তাদের সফরসঙ্গী হওয়া। এরা ব্যর্থ হলে ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ জায়গাটুকুও আমাদের হাতছাড়া হবে
অন্যদের, বিশেষত অনুগত বুদ্ধিজীবীদের বড়জোর বোতলের চুইয়ে পড়া মধুর ছিটেফোঁটার ভাগ পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। তবে তাঁদের ‘নৈতিক সান্ত্বনা’ হিসেবে ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি। যখনই দুঃশাসনের সমালোচনা উচ্চারিত হয়েছে, এমনকি সামাজিক বৃত্তে সীমাবদ্ধ সে সমালোচনাও তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন এই যুক্তিতে যে এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে কারণে তাদের কোনো বিকল্প নেই।
স্বৈরাচার, যার একমাত্র লক্ষ্য যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকা, সে যে কখনো মুক্তিযুদ্ধের ধারক হতে পারে না—এই সাধারণ সত্যটুকুও তাঁদের বিবেচনায় প্রবেশ করেনি। ফলে এখন এমন দাবি করা মোটেই অযৌক্তিক নয়, সুবিধাভোগী এই তাঁবেদার গোষ্ঠীও স্বৈরাচারের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও অপশাসনের জন্য দায়ী।
একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে, তারা বরাবরই নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারী হিসেবে বৈধতা দাবি করেছে। ক্ষমতার শীর্ষে যাঁরা অবস্থান নেন, তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন বিগত শতকের রাজনীতিক। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নেতৃত্বে প্রজন্মগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। এর ফলে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে তাঁদের ব্যবধান বেড়েছে, সৃষ্টি হয়েছে অনপনেয় দূরত্ব। বিগত প্রজন্ম তাঁদের ক্ষমতা ও সুবিধাভোগ চিরস্থায়ী করতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যে অপব্যবহার করেছেন, নব প্রজন্মের মনে তা গভীর প্রত্যাখ্যানের জন্ম দিয়েছে।
আরও একটি পরিবর্তন আমাদের অলক্ষ্যে জন্ম নিয়েছে। নতুন যে প্রজন্ম, যারা আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ ও বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত, বাংলাদেশের স্থবির রাজনৈতিক বাস্তবতাকে একমাত্র সত্য হিসেবে মানতে তারা প্রস্তুত ছিল না। তারা আরব বসন্তের কথা পড়েছে। লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে এক নবীন নেতৃত্বের আবির্ভাব দেখেছে। যুক্তরাজ্যে রক্ষণশীলদের নির্বাচনী বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শী তারা। ‘পরিবর্তন সম্ভব’, এটি তাদেরই স্লোগান। বাংলাদেশে এই নতুন প্রজন্মের হাতেই ঘটল অভাবিত এক বিপ্লব।
তবে শিক্ষার্থী ও নব প্রজন্মের প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হলো, তাকে ‘বিপ্লব’ বলা যায় কি না, তা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। বিপ্লব মানে বিগতের সঙ্গে পূর্ণচ্ছেদ। আওয়ামী সরকারের পতনের পর যে সামান্য কয়েক দিন গেছে, তা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলার সময় হয়তো আসেনি, কিন্তু একটি লক্ষণ বা প্রবণতা নজরে পড়ছে।
স্বৈরাচার পতনের পরমুহূর্ত থেকেই ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের জন্য আঁক কষা শুরু করেছে পুরোনো, প্রত্যাখ্যাত রাজনৈতিক স্বার্থবাদী মহল। সবচেয়ে অধিক দৃশ্যমান সেই সব গোষ্ঠী, যাদের একসময় আমরা ধর্মীয় রাজনীতিক হিসেবে নিন্দা করেছি। আওয়ামী নেতৃত্বের অনুপস্থিতির ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে কোনো বাধা ছাড়াই ঢুকে পড়েছে তারা।
নতুন যে প্রজন্মের হাতে পরিবর্তন সূচিত হলো, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, এমন সম্ভাবনায় অথবা আশঙ্কায় তাঁরা মোটেই উদ্বিগ্ন নন। যে দুর্নীতিমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক সুশাসিত বাংলাদেশের কথা তাঁরা ভাবছেন, সে রূপরেখার সঙ্গে সম্মতি পোষণ করে এমন সবাই তাঁদের কাছে আমন্ত্রিত। যারাই পুরোনো বাংলাদেশকে পুনরাবিষ্কারে আগ্রহী হবে, যারা গতকালের অন্ধকূপে আবারও আমাদের ঠেলে দিতে চাইবে, তারাও সদ্য পলাতক স্বৈরাচারের ভাগ্য বরণ করবে, এমন সাহসী ঘোষণা তাঁরা দিয়েছেন।
আমি নতুন প্রজন্মের এই ঘোষণায় ও তাদের নেতৃত্বে আস্থাবান। আমরা যা পারিনি, তারা সেটা করে দেখিয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের সবার দায়িত্ব তাদের সে স্বপ্নযাত্রায় সমর্থন দেওয়া, তাদের সফরসঙ্গী হওয়া। এরা ব্যর্থ হলে ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ জায়গাটুকুও আমাদের হাতছাড়া হবে।
● হাসানফেরদৌস প্রাবন্ধিক