ঢাকার কলাবাগান এলাকা থেকে ১৭ ডিসেম্বর রাত ১১টার দিকে বাসে করে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলাম।
১৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে সাতটায় পৌঁছে গেলাম কক্সবাজার শহরের ডলফিন মোড়ে। বাস থেকে নেমেই দূরে সমুদ্রের নীল জলরাশি দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত ভাগনে-ভাগনিসহ অন্যরা।
দুটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে আমরা সুগন্ধা সমুদ্রসৈকতের পাশে আগেই বুকিং দিয়ে রাখা হোটেলে চলে গেলাম।
সকালের নাশতা শেষ করে সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার টিকিটের খোঁজ করতে শুরু করলাম। অনলাইনে দেখলাম সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার টিকিট নেই। আমরা যে হোটেলে উঠেছি, সেটি মধ্যম মানের। হোটেলটির ব্যবস্থাপক জানালেন, টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।
অনলাইনে তো টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না, কীভাবে ব্যবস্থা হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে হোটেল ব্যবস্থাপক বললেন, তাঁদের সঙ্গে জাহাজের লোকজনের যোগাযোগ আছে, টিকিটের ব্যবস্থা হবে।
তাঁর কথায় খুব একটা ভরসা পেলাম না। আশপাশের হোটেল, মোটেল ও বিভিন্ন কাউন্টারে সেন্ট মার্টিনের টিকিটের সন্ধান করেও টিকিট পাওয়া গেল না। তাই বাধ্য হয়ে হোটেল ব্যবস্থাপকের কাছে আবার শরণাপন্ন হলাম। তিনি বললেন, টিকিটের ব্যবস্থা তিনি করে দিতে পারবেন, সমস্যা হবে না। তবে যাতায়াতের প্রতিটি টিকিটের দাম পড়বে ২ হাজার ৭০০ টাকা।
যদিও টিকিটপ্রতি মূল্য ২ হাজার ৫০০ টাকা। বিকল্প উপায় না পেয়ে ২ হাজার ৭০০ টাকায় টিকিট নিতে আমরা রাজি হলাম। আমাদের দলে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন সদস্য এবং এক শিশু। জরুরি কাজে ছোট ভাই ঢাকা চলে যাবে, তাই ৯টি টিকিট কেনার সিদ্ধান্ত হলো।
জাহাজের টিকিটের সঙ্গে সেন্ট মার্টিনে থাকার জন্য হোটেলের ভাড়াও পরিশোধ করতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন ওই হোটেল ব্যবস্থাপক। এখন যেহেতু সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেন্ট মার্টিনে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি পর্যটক যাওয়ার সুযোগ নেই, তাই অনেক হোটেল-মোটেল ফাঁকা থাকে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, খুবই অল্প খরচে সেখানে থাকা যায়। সে জন্য আমরা অগ্রিম হোটেল বুকিং দিতে অস্বীকৃতি জানালাম।
হোটেল ব্যবস্থাপক সাফ জানিয়ে দিলেন, সেন্ট মার্টিনের টিকিট নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলে থাকার কক্ষের ভাড়াও পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক। তা ছাড়া টিকিট বিক্রি হয় না। এটাই এখন সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার সিস্টেম। সিন্ডিকেট চক্র এভাবেই সব সিস্টেম করে রেখেছে।
অনেক চেষ্টা করেও সিস্টেমের বাইরে আসতে পারলাম না। সম্প্রতি সেন্ট মার্টিনফেরত এক সহকর্মীও জানিয়েছিলেন, জাহাজের টিকিট কাটার সময়ই হোটেল বুকিংয়ের টাকা পরিশোধ করতে হয়। আমরাও বাধ্য হয়ে তাদের সিস্টেম মেনে নিয়ে ৯ জনের টিকিটের জন্য ২৪ হাজার ৩০০ টাকা ও সেন্ট মার্টিনে হোটেলে এক রাতের জন্য দুটি ফ্ল্যাটে চারটি শয্যার ভাড়া বাবদ দর-কষাকষি করে সাত হাজার টাকা ঠিক করলাম।
হোটেল ব্যবস্থাপকের চাওয়া অনুযায়ী, আমরা অগ্রিম ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করলাম। বাকি টাকা টিকিট হাতে পেলে পরিশোধ করা হবে। হোটেল ব্যবস্থাপক জানালেন, সন্ধ্যায় টিকিট দেওয়া হবে।
পরে আমরা সরল ও উচ্ছ্বসিত মনে সবাই হিমছড়ি ঘুরতে চলে গেলাম। সন্ধ্যায় হিমছড়ি থেকে সরাসরি কক্সবাজার শহরের রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ডের পথে রওনা হলাম। আর যুবক ছোট ভাইকে সেন্ট মার্টিনের টিকিট সংগ্রহের জন্য ব্যবস্থাপকের কাছে পাঠানো হলো।
ওই ব্যবস্থাপককে বাকি ছয় হাজার টাকা দিয়ে একটি রসিদ আনল ছোট ভাই। রাতে হোটেলকক্ষে ফেরার পর সবাই আগামীকাল (১৯ ডিসেম্বর) সেন্ট মার্টিন যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। ছোট ভাইকে টিকিটের বিষয় জিজ্ঞাসা করতেই সে জানাল, একটি রসিদ দিয়েছে, কাল সকালে টিকিট দেবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার সেন্ট মার্টিনে প্রতিদিন দুই হাজার পর্যটককে যাওয়ার অনুমতির ব্যবস্থা রেখে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। এ পদ্ধতির কারণে কত পর্যটক যে দালালের খপ্পরে পড়ছেন, সেদিকে কর্তৃপক্ষের কি নজর আছে?
১৯ ডিসেম্বর সকাল আটটার আগেই যার যার লাগেজ নিয়ে হোটেল কাউন্টারে গিয়ে আমরা হোটেল ব্যবস্থাপকের কাছে জাহাজের টিকিট চাই। ব্যবস্থাপক জানালেন, জাহাজঘাটে চলে যান, সেখানে আপনাদের এমভি বার আউলিয়া জাহাজের টিকিট দেওয়া হবে।
এবার আমাদের টনক নড়ল। ‘সামথিং ইজ রং’ মনে হলো। টিকিট কেন ঘাটে দেওয়া হবে? এখনই টিকিট দিতে হবে বলে আমরা বাগড়া দিলাম। শুরু হলো বাগ্বিতণ্ডা। ব্যবস্থাপক বললেন, ‘জাহাজঘাটে গিয়ে টিকিট না পেলে আপনারা যাবেন না। টাকা ফেরত পাবেন।’
শেষ পর্যন্ত আমরা কক্সবাজার শহরের নুনিয়ার চর এলাকায় জাহাজঘাটে গেলাম। সবাই মিলে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ব্যবস্থাপককে মুঠোফোনে ফোন করে বললাম, ‘কোথা থেকে আমরা টিকিট নেব?’ ব্যবস্থাপক জানালেন, কিছুক্ষণের মধ্যে ফোনে কথা বলে দেখা করে টিকিট পৌঁছে দেবেন।
আমরা অপেক্ষা করছি, কিন্তু কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না। এদিকে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। সকাল ১০টায় সর্বশেষ জাহাজ হিসেবে ছাড়ার অপেক্ষায় থাকা এমভি বার আউলিয়া কিছুক্ষণ পরপর সাইরেন বাজিয়ে যাচ্ছে। সেন্ট মার্টিনগামী পর্যটকেরা জাহাজে উঠছেন।
এরই মধ্যে ফোন করে দুই যুবক আমাদের কাছে এসে টিকিট হাতে দিলেন। টিকিট হাতে পেয়ে চক্ষু চড়কগাছ। ৯টি টিকিটই ‘স্ট্যান্ডিং’, মানে সবাইকে জাহাজে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। প্রতিটি টিকিটের গায়ের মূল্য এক হাজার টাকা, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে প্রতিটি টিকিট ২ হাজার ৭০০ টাকা করে। আমাদের সবার মেজাজ তখন চরমে।
বৃদ্ধ মা–বাবা, মামি ও বড় বোনকে নিয়ে ‘স্ট্যান্ডিং’ টিকিটে ছয় ঘণ্টার জাহাজ ভ্রমণ অসম্ভব। ঘাটপাড়ে আরও কয়েকজনকে দেখা গেল, তাঁরাও আমাদের মতো দালালের খপ্পরে পড়ে প্রতারিত হয়েছেন। ক্ষুব্ধ হয়ে ফোন করলাম সেই ব্যবস্থাপককে। তিন বললেন, ‘আপনাদের জন্য এসব টিকিটই বরাদ্দ।’
সবাইকে ঘাটপাড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে আমি, আমার ছোট ভাই ও দুলাভাই তিনজন মিলে অটোরিকশায় করে রওনা হলাম হোটেলের উদ্দেশে ওই ব্যবস্থাপকের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। আমাদের দেখে ব্যবস্থাপক ভড়কে গেলেন। সেখানে আরেক দফায় হোটেলের লোকজনের সঙ্গে আমাদের বাগ্বিতণ্ডা হয়।
একপর্যায়ে সেই ব্যবস্থাপক আমাদের তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে জাহাজঘাটে আসেন টিকিটের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। ওই হোটেল ব্যবস্থাপক অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত আমাদের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারেননি। কিছুক্ষণ পর আমাদের চোখের সামনে জাহাজটি ছেড়ে যাচ্ছে; আমরা ঘাটপাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছি।
আমি কেবল তরুণ ভাগনে ও ভাগনির চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। দুজনের অপলক দৃষ্টি, ছলছল চোখে জল। যেন দুজনের বুকের ভেতর নীরব কান্না, নীরবেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ভাগনে-ভাগনির চোখেমুখে এমন শূন্যতা ও হাহাকার কোনো দিন দেখিনি।
লাগেজ নিয়ে সবাই আবার সেই হোটেলে ফিরে এলাম। সবাইকে কক্ষে পৌঁছে দিয়ে আমরা তিনজন গেলাম হোটেল কাউন্টারে। সেই হোটেল ব্যবস্থাপক দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি ক্ষমা চেয়ে বসলেন। আমাদের প্রদত্ত মোট ৩১ হাজার টাকা ফেরত দিলেন। হোটেল মালিককে ঘটনাটি জানাতে চাইলাম, আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইলাম।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেই ব্যবস্থাপক কয়েকবার আমাদের কাছ মাফ চেয়েছেন। বলেছেন, মালিককে ঘটনাটি জানালে তাঁর চাকরি থাকবে না। পরিবার সংসার নিয়ে বড় বিপদে পড়বেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কারও সঙ্গে এমন করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন।
তাঁর এমন করুণ প্রার্থনা দেখে আমরা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকলাম। আমরা ঢাকায় চলে আসার পরও হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস রেকর্ড পাঠিয়েও ক্ষমা চেয়েছেন সেই ব্যবস্থাপক। যে কারণে এ লেখায় ওই ব্যবস্থাপকের ও হোটেলের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার সেন্ট মার্টিনে প্রতিদিন দুই হাজার পর্যটককে যাওয়ার অনুমতির ব্যবস্থা রেখে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। এ পদ্ধতির কারণে কত পর্যটক যে দালালের খপ্পরে পড়ছেন, সেদিকে কর্তৃপক্ষের কি নজর আছে?
দেশে ভ্রমণ এমনিতে ব্যয়বহুল। সরকারি সিদ্ধান্তে ও সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ম্যে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। সিন্ডিকেট চক্রের এখন রমরমা অবস্থা। সেন্ট মার্টিন যেন গরিব, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। সেন্ট মার্টিনকে দুর্লভ নয়, সহজলভ্য করতে হবে। সিন্ডিকেট ও প্রতারক চক্র থেকে সেন্ট মার্টিনকে বাঁচানোর দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]