পাহাড়, নদী, খাল, ফুটপাত—এসব সব সময় দখলে থাকবে। এই অনিয়ম চট্টগ্রামে নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় নিয়মিত কাটা হবে। কর্তিত পাহাড়ে মানুষের বসতি গড়ে উঠবে। আর একটু জোরে বৃষ্টি হলেই নড়বড়ে পাহাড় ধসে পড়ে মানুষের মৃত্যু হবে। নদীর দুই পাড় দখল আর দূষণ হবে, নাব্যতা হারাবে, মাছসহ নানা জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে। খালও দখলের আওতায় থাকবে, জলাবদ্ধতা থেকে মানুষ যেন কোনো দিন মুক্ত না হয়। আর নগরের সব ফুটপাত হকারেরা চুরি করে নিয়ে যাবেন, পথচারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাঁটবেন রাস্তা দিয়ে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় না।
উচ্ছেদ অভিযান, জরিমানা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় পাহাড় থেকে সরিয়ে আনা হয়। সব চলে, তবু যেন চলে না। নইলে পাহাড় মুক্ত হয় না কেন? নদী, খাল, ফুটপাত অবাধ খোলা দেখি না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জটিল গোপন রোগের উৎসের মতো। কোনো চিকিৎসক, কোনো গবেষক খুঁজে বের করতে পারবেন না। বরং পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, দখলের নিয়ম যাঁরা চালু করছেন, তাঁদের দাপট দিন দিন বাড়ছে। সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে গত বৃহস্পতিবার উচ্ছেদ অভিযান শেষে ফেরার সময় দখলদারদের হামলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম, সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদসহ ১০ জন আহত হয়েছেন। দখলদারি তাঁদের অস্থিমজ্জায় আসন গেড়ে নিয়েছেন। তাঁরা কাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এ রকম দুর্বিনীত আচরণ করার সাহস পান।
এই হামলার পরপর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তানভির আল নাছির এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাধা কিংবা হামলা যা-ই আসুক, জঙ্গল সেলিমপুরে সরকারি জমি উদ্ধারে পিছু হাঁটবে না জেলা প্রশাসন। প্রশাসনের এই অঙ্গীকার, এই আশা যেন পূরণ হয়। কিন্তু এমন দৃঢ় উচ্চারণের পরও আমাদের মন থেকে শঙ্কা যায় না। কারণ, এ রকম উচ্চারণ চট্টগ্রামে পাহাড়, নদী, খাল ও ফুটপাত সম্পর্কে বারবার শুনে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ কখনোই কিছু হয়নি।
গত ৪০ বছরে চট্টগ্রামের কমপক্ষে ১২০টি পাহাড় বিলীন হয়েছে। পাহাড় রক্ষা করতে নানা সময়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি হিসাবে নগরের ২৬টি পাহাড়ে বাস করছে সাড়ে ৬ হাজার পরিবার। পাহাড় কাটার সঙ্গে জনপ্রতিনিধির মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত। পরিবেশ অধিদপ্তর তাঁদের বিরুদ্ধে জরিমানা করেই দায় সারে। কিন্তু তাঁদের পাহাড় কাটা বন্ধ হয় না। একদিকে পাহাড় কাটবে, আর জরিমানা দেবে। জরিমানার কারণে সরকারি কোষাগারে টাকা বাড়ে, তাতে চট্টগ্রাম ধ্বংস হয়।
কর্ণফুলী নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য উচ্চ আদালতের আদেশও আছে। সেই আদেশের ওপর ভিত্তি করে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৬ দিন টানা অভিযান চলেছে। এই অভিযানে ২৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছিল। এরপর অনেক বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু ক্রমবর্ধমান দখলদারদের দমানোর কোনো বড় ধরনের প্রয়াস প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা হয়নি।
চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের সারা বছর বিড়ম্বনার বিষয়টি হচ্ছে ফুটপাত। এই শহরের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার ফুটপাত। এর বেশির ভাগ হকাররা করায়ত্ত করেছেন। শুধু ফুটপাত নয়, অনেক এলাকায় ফুটপাত ছাড়িয়ে রাস্তায়ও তাঁদের দখলদারির বিস্তৃত হয়েছে। ফুটপাত ও রাস্তা দখল সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায়। চট্টগ্রাম নিউমার্কেট এলাকাটির কাছে শহরের বিখ্যাত এ সবচেয়ে বড় বিপণিকেন্দ্র রিয়াজ উদ্দিন বাজার। রিয়াজ উদ্দিন বাজারের একপাশে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন, অন্য পাশে চৈতন্যগলি, তিনপুল, আমতলা—সব মিলিয়ে প্রায় চার কিলোমিটার এলাকায় কোনো ফুটপাত চোখে পড়ে না। এখানকার রাস্তার বেশির ভাগে পথবিক্রেতারা বসে পণ্য বিক্রি করেন। রাস্তার আর কিছু অংশ শহর এলাকার বাস, অটোরিকশা, রিকশার দখলে। পথচারী এখানে নিতান্ত অসহায়। এ রকম অবস্থা আগ্রাবাদ বহদ্দারহাট ইপিজেডসহ নগরের প্রায় সবখানে। এর সঙ্গে রয়েছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং।
এসবের কারণে নগরের ট্রাফিকব্যবস্থা কিছুতেই শৃঙ্খলায় আনা যাচ্ছে না। যানজট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মানুষের জীবনকে করে তুলছে দুর্বিষহ। চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন সড়কে বিশৃঙ্খলা দূর করতে সম্প্রতি ট্রাফিক পুলিশ প্রায় সব মোড়ে যান চলাচলের সড়ক নির্দেশনা দিয়েছে। এলোমেলো যান চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট লাইনে চলার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। এত কিছুটা শৃঙ্খলা এলেও বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি। পরিবহনব্যবস্থাকে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসার জন্য কোনো পরিকল্পনা নেই। এই শহরে প্রতিদিন পাঁচ লাখেরও বেশি যানবাহন চলছে এবং সেটি দিন দিন বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান যানবাহন ও মানুষ সমস্যাকে দিন দিন প্রকট থেকে প্রকটতর করে তুলছে।
এদিকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নগরের সড়কগুলোর অবস্থা হয়েছে বেহাল। প্রবল বৃষ্টি, জলাবদ্ধতার পর সড়কজুড়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তার মেরামতের অবকাশ পায়নি সিটি করপোরেশন। অথচ এর মধ্যেই মাস পেরিয়ে গেছে। সড়কে গর্ত ও খানাখন্দ। সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, এবার বর্ষার মৌসুমে কমপক্ষে ৫০ কিলোমিটার পথ নষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নন্দনকানন কে সি দে সড়ক, জামাল খান, সারসন রোড, ডিসি সড়ক, মুরাদপুর, শুলকবহর ও বহদ্দারহাট, কে বি আমান আলী সড়ক, শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ সড়ক, লয়েল রোড, খাজা সড়ক, চান মিয়া সড়ক, বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক, হাটহাজারী (মুরাদপুর-অক্সিজেন) সড়ক, ওমর আলী মাতব্বর সড়ক, মাইজপাড়া সড়ক, পিলখানা সড়ক, জাকির হোসেন সড়ক, সুন্নিয়া মাদ্রাসা সড়ক, মোহাম্মদপুর সড়ক, খতিবের হাট সড়ক। সড়কের করুণ অবস্থা নগরের বিশৃঙ্খলাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দখলদারি, যানবাহন ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা চট্টগ্রামের জনজীবনে যে অস্বস্তি বিরাজ করছে, তার নিরসন দরকার।
পাহাড় দখল কারা করছেন, বারবার উচ্ছেদর পরও কেন তা পুনর্দখল হয়? কর্ণফুলীর তীর আদালতের নির্দেশের পরও কেন উচ্ছেদ হয় না, ফুটপাত গ্রাসকারীদের কারা ছাড়পত্র দিচ্ছেন? জনমনের এসব প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পাহাড় দখল করে, পাহাড় কেটে নগরের পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া, নদী দখল ও দূষণ করে, খাল দখল করে মানুষকে জলাবদ্ধতার কবলে ফেলে জীবনকে দুর্ভোগময় করার অধিকার কারও নেই। একই ভাবে ফুটপাত গ্রাস করে নিয়ে মানুষের চলাচলে অধিকার কেড়ে নিয়ে ব্যবসাপাতি চালানোর অধিকারও কারও থাকতে পারে না। মানুষের অধিকারের বিষয়টি যত তাড়াতাড়ি প্রশাসন বুঝবে, ততই নাগরিক ও সরকার উভয়ের জন্য মঙ্গল।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক