তাহলে বিএনপির যুক্তিই মেনে নিল আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম ভিত্তি গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান হলো সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী সত্তরের নির্বাচনের রায় বানচাল করেছিল বলেই এ দেশের মানুষ ১৯৭১ সালে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে। 

স্বাধীনতার পর মাত্র ১০ মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার একটি সংবিধান দেশবাসীকে উপহার দিয়েছিল। পাকিস্তান এই সংবিধান রচনা করতে সময় নিয়েছিল ৯ বছর। ভারত আড়াই বছর। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান রচয়িতারা কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন। 

আমাদের সংবিধানে যে চার মূলনীতির কথা আছে, সেখানে জাতীয়তাবাদের পরই গণতন্ত্র। অপর দুটি হলো সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। গত ৫৩ বছরে দেশে গণতন্ত্র নিয়ে অনেক পরীক্ষা–নিরীক্ষা হয়েছে। আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে। এরপর একদলীয় শাসন কায়েম হলো। সেটাও বেশি দিন টেকেনি।

পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসকেরা গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করলেন। আগে ক্ষমতা দখল করো, পরে সেটা নির্বাচনের মাধ্যমে অনুমোদন করিয়ে নাও।

সত্তর দশকের শেষার্ধে ও পুরো আশির দশকজুড়ে দেশে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, তারও লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র। নব্বইয়ে ছাত্র–তরুণ ও তিন রাজনৈতিক জোটের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলন গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে হয়। 

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হয়, সেটি দেশের ভেতরে–বাইরে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এই নির্বাচনে অনেককে অবাক করে দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আসনে বসে। এরপর আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও বাম দলগুলো নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং বিএনপি সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করে। 

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে (১২ জুন) প্রথম সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনে ফের বিএনপি সরকার গঠন করে।

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যেই নির্বাচনটি হওয়ার কথা ছিল, সেটি হতে পারেনি বিএনপির গোঁয়ার্তুমির জন্য। তার আগেই ১/১১–এর রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে এবং সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকে। অন্তরে যা–ই থাকুক না কেন, তারাও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয়। এই নির্বাচনে দুই–তৃতীয়াংশের বেশি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে। 

নির্দলীয় অন্তর্বর্তী কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে একটা দ্বিদলীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর সেই ধারারও অবসান হলো।

এরপর ২০১৪, ২০১৮, ও ২০২৪ সালে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাতে ক্ষমতাসীনদের জয় নিশ্চিত হলেও বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।

আরও পড়ুন

২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি ও তার সহযোগীরা বর্জন করে। যদিও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রস্তাব মেনে সর্বদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে রাজনীতির ধারা ভিন্ন হতে পারত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ‘দিনের ভোট রাতে হয়েছে’ বলে অভিযোগ আছে। আর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি যে নির্বাচন হলো, তাতে আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল—

নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী। কোথাও কোথাও দল থেকে চার–পাঁচজন প্রার্থীও দাঁড়িয়েছেন। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাঁদের মনোনয়ন দিয়েছিল, তঁাদের মধ্যে ৬২ জন জয়ী হতে পারেননি। ওই সব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। 

আসন্ন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে যে প্রচণ্ড অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, তারও কারণ ৭ জানুয়ারির নির্বাচন। স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আমেজ আনলেও দলের ভেতরে অন্তর্দাহ শুরু হয়েছে, যা সহজে মিটবে বলে মনে হয় না। দৃশ্যত এই শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে যে কটি হতাহত ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, তা আওয়ামী লীগের নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনুসারীদের মধ্যে। নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হয়েছেন, তাঁরাই নিজেদের ‘রাজা’ মনে করেন। পরাজিত প্রার্থীরা তাঁদের কাছে ‘পরিত্যক্ত’। এর জের উপজেলা নির্বাচনেও পড়েছে। 

বহুদলীয় গণতন্ত্রে নির্বাচন হয় মূলত নীতি–আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে। কিন্তু গণতন্ত্রের কাফেলা থেকে উঠে আসা আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনকে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির লড়াইয়ে পরিণত করেছে। আগে বিরোধী দল জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে অংশ নিত। কিন্তু ২০১৫ সালে সেটাকেও সরকার দলীয়করণ করল। এরপর বিরোধী দলও নির্বাচন বর্জনের পরিধি বাড়িয়ে চলেছে। 

প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, দলের মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ইতিমধ্যে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকেরা নিজ নিজ বিভাগের মন্ত্রী–সংসদ সদস্যদের দলের এই নির্দেশ জানাতে শুরু করেছেন। এরপরও কেউ নির্বাচন থেকে সরে না দাঁড়ালে বহিষ্কারসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। (প্রথম আলো, ১৯ এপ্রিল ২০২৪)

কেন আওয়ামী লীগকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো? নিতে হয়েছে এ কারণেই যে স্থানীয় রাজনীতিতে মন্ত্রী–এমপিরা প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। স্থানীয় প্রশাসন তাঁদের কথার বাইরে যেতে পারে না। মন্ত্রী–এমপি যা বলবেন, সেটাই চূড়ান্ত। অনেকে দলীয় নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেই জয়ী হয়েছেন। 

আওয়ামী লীগকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুটি কারণে। প্রথমত ৭ জানুয়ারির পর প্রতিটি আসনে যে এমপির অনুসারী ও বিরোধী গ্রুপ তৈরি হয়েছে, সেটা সামাল দিতে। দ্বিতীয়ত মন্ত্রী বা এমপির ছেলেমেয়ে কিংবা অন্য কোনো স্বজন নির্বাচন করলে সেখানে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রভাবিত করার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। এমনকি নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদেরও তাঁরা প্রভাবিত করতে পারেন। 

এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বিএনপির যুক্তিই মেনে নিল। বিএনপি বলেছিল, দলীয় মন্ত্রী থেকে নির্বাচন করলে তাঁরা প্রশাসনকে প্রভাবিত করবেন। বিএনপি বলেছিল, একটি সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে বৈষম্য তৈরি হবে। একজন এমপির সুযোগ–সুবিধা নেবেন। অন্যরা সেটি থেকে বঞ্চিত হবেন। আওয়ামী লীগ সে সময়ে বিএনপির কথা শোনেনি। যেমন বিএনপিও আওয়ামী লীগের কথা শোনেনি ক্ষমতায় থাকতে। এখন আওয়ামী লীগ বিএনপির যুক্তি দিয়েই মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাইছে। 

বহুদলীয় গণতন্ত্রে নির্বাচন হয় মূলত নীতি–আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে। কিন্তু গণতন্ত্রের কাফেলা থেকে উঠে আসা আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনকে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির লড়াইয়ে পরিণত করেছে। আগে বিরোধী দল জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে অংশ নিত। কিন্তু ২০১৫ সালে সেটাকেও সরকার দলীয়করণ করল। এরপর বিরোধী দলও নির্বাচন বর্জনের পরিধি বাড়িয়ে চলেছে। 

বাংলাদেশে এখন নির্বাচন হয় বিরোধী দলকে ছাড়াই; ভোট হয় একই দলের দুই বা অধিক প্রার্থীর মধ্যে। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনে নাগরিকের পছন্দ করার যে অবারিত সুযোগ, সেটি পুরোপুরি অনুপস্থিত। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]