কাতার বিশ্বকাপ কতটা রাজনীতিমুক্ত হতে পেরেছে?

কাতার বিশ্বকাপে ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে দর্শকেরা
ছবি: রয়টার্স

এবার ফিফা কাতার বিশ্বকাপ উপলক্ষে নতুন একটি স্লোগান সামনে এনেছে। সেটি হলো, ‘বিশ্বকে এক করেছে ফুটবল’। ফিফা প্রচারণার জন্য যে ভিডিওটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে, সেখানে আর্জেন্টিনার ফুটবল তারকা লিওনেল মেসি ও ব্রাজিলের নেইমার স্প্যানিশ ও পতুর্গিজ ভাষায় এ কথাগুলো উচ্চারণ করেছেন। সত্যিই কি ফুটবল বিশ্বকে একত্র করেছে?

 অবশ্যই নয়। এমনকি একটা জাতিকেও একত্র করতে পারে না ফুটবল। ব্রাজিলের কথাই ধরা যাক। দলটির হলুদ ও সবুজ জার্সির রং সম্প্রতি ক্ষমতা হারানো প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর সমর্থকেরা বেছে নিয়েছে। নেইমার এতে সমর্থন দিয়েছেন। এ ঘটনা প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভার সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। এ পক্ষকে সমর্থন দিয়েছেন দলটির কোচ তিতে ও স্ট্রাইকার রিচার্লিসন।

খেলা বিশ্বের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, এটি অনেক পুরোনো ধারণা। এর জন্য ফিরে যেতে হবে ১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিকের জনক ব্যারন পিয়েরে দা কুবেরত্যাঁর কাছে। ব্যারন এবং তাঁর উত্তরসূরিরা মনে করেন, খেলাধুলা আন্তর্জাতিক রাজনীতি, উত্তেজনা অথবা যেকোনো সংঘাতের বাইরের একটি বিষয়। ফিফাও রাজনীতিমুক্ত একটি কাল্পনিক জগতের ধারণাকে লালন করে, যেখানে প্রতিযোগিতা খেলার মাঠেই আবদ্ধ থাকবে।

প্রকৃতপক্ষে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ হিসেবে তেলসমৃদ্ধ ছোট দেশ কাতারকে বেছে নেওয়াটা একটি বড় রাজনৈতিক ঘটনা। ফুটবলের কোনো ইতিহাস নেই কাতারের, এই খেলার সঙ্গে স্থানীয়দের বড় কোনো স্বার্থও নেই। দেশটির শাসকেরা বিশ্বকাপের মতো মর্যাদাবান আসরের আয়োজক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন এবং সেটা কিনে নেওয়ার মতো অর্থ তাঁদের হাতে রয়েছে। গুঞ্জন আছে, কাতারের সমর্থনে ভোট দেওয়া ফিফা কর্মকর্তাদের পকেটে মোটা অঙ্কের টাকা পৌঁছেছিল। কাতারের রাষ্ট্রীয় অর্থে পরিচালনাধীন আল-জাজিরাকে সম্প্রচার অধিকার দিয়ে ফিফা তার প্রতিদান দিয়েছে। কাতারের বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘন, অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার হরণ, সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে দেখা—এ ধরনের সমালোচনা ফিফা স্পষ্টত সহ্য করছে না। যদিও এর থেকেও বিতর্কিত জায়গায় আন্তর্জাতিক খেলার আসর বসেছে। গত বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক দেশ ছিল রাশিয়া। সে সময় দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাও ছিল। ১৯৩৬ সালে হিটলারের বার্লিনে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

আধুনিক ফুটবলের অন্যতম একটি তামাশা হচ্ছে, জাতীয় দলগুলোকে ঘিরে একটা দেশপ্রেমের উদ্দীপনা তৈরি হয়। এ কারণে জাতীয় শাসকেরা দেশের ফুটবলের রঙে নিজেদের মুড়ে ফেলতে চান। কিন্তু একেকটা জাতীয় দলের ফুটবলাররা বেশির ভাগই ইউরোপের ক্লাবগুলোর খেলোয়াড়। তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বললেও মাঠে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে কোনো একটি দেশের হয়ে উগ্র স্বাদেশিকতার প্রচার করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। 

আরব বিশ্বের ছোট্ট দেশ কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন যেমন করেছে, আবার নিজেদের প্রতিপত্তিও তারা দেখিয়েছে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির মতো ফিফাও সব সময় টাকার ক্ষমতার কাছে মাথা নুইয়ে আসছে। কোনো খেলোয়াড়, দর্শক ও ইউরোপের বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তি ‘ওয়ান লাভ’ লেখা বাহুবন্ধনী নিয়ে কাতার প্রবেশ করতে পারেননি। মানুষের ভালোবাসার অধিকারকে ফিফা রাজনৈতিক বিবৃতি বলে বিবেচনা করেছে। খেলার সঙ্গে রাজনীতি মিশুক, সেটা চায় না ফিফা। কিন্তু খেলার সঙ্গে রাজনীতি তো মিশছেই। যেমন ইরান, সৌদি আরব কিংবা কাতারের সমর্থকেরা যখন ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছেন, সেটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে ফিফার কাছে। একমাত্র জার্মান ফুটবল দলই যৌনতার স্বাধীনতার সমর্থনে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছে। ফিফা কর্তৃপক্ষ খুব দ্রুত গিয়ে এ প্রতিবাদ বন্ধের জন্য বলেছে, অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছে। কাতারের বিরুদ্ধে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো অভিযোগের বিরুদ্ধে পাল্টা বর্ণবাদের যুক্তি তোলা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর বলা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের ‘তিন হাজার বছরের’ ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। স্টেডিয়ামে ‘নারী’ এবং ‘স্বাধীনতা’ লেখা কোনো টি–শার্ট নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইরানের কট্টরপন্থী শাসকেরা খেপে যাবেন কি না, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ফিফা।

আরও পড়ুন

আন্তর্জাতিক সংহতির জন্য ফিফার পক্ষ থেকে কত কিছু করা হচ্ছে। অথচ ফুটবলকে কেন্দ্র করে জাতীয় অনৈক্য কি ঠেকানো যাচ্ছে? ইরানি অনেক নারীকে মাথায় স্কার্ফ না পরেই জাতীয় দলকে সমর্থন দিতে দেখা গেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইরানের ফুটবল দল হেরে যাওয়ায় তেহরানসহ অনেক শহরে আনন্দ করতে দেখা গেছে। সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটেছে ইংল্যান্ডের সঙ্গে ইরানের প্রথম খেলার দিনে। ইরানের খেলোয়াড়েরা তাঁদের দেশের নারী আন্দোলনের সমর্থন জানিয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে অস্বীকৃতি জানান। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড ফুটবল খেলোয়াড়দের এ ধরনের সাহসী কাজ আর না করতে সতর্ক করে দেয়।

এ বিশ্বকাপের অন্যতম বড় অঘটন জার্মান ফুটবল দলের পরাজয়। বেশির ভাগ জাতীয় দলের মতো জার্মান দলটিও বহুজাতিক একটি দল। অথচ জার্মান রক্ষণশীলেরা দাবি করেছেন, বিভিন্ন জাতির খেলোয়াড় নিয়ে গড়ে ওঠায় জার্মান দলটিতে লড়াইয়ের স্পৃহা ছিল না।

আধুনিক ফুটবলের অন্যতম একটি তামাশা হচ্ছে, জাতীয় দলগুলোকে ঘিরে একটা দেশপ্রেমের উদ্দীপনা তৈরি হয়। এ কারণে জাতীয় শাসকেরা দেশের ফুটবলের রঙে নিজেদের মুড়ে ফেলতে চান। কিন্তু একেকটা জাতীয় দলের ফুটবলাররা বেশির ভাগই ইউরোপের ক্লাবগুলোর খেলোয়াড়। তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বললেও মাঠে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফলে কোনো একটি দেশের হয়ে উগ্র স্বাদেশিকতার প্রচার করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। 

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট 

ইয়ান বুরুমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বিয়িং স্পেশাল বইয়ের লেখক

আরও পড়ুন