ঢাকার এক বেসরকারি হাসপাতালের নিবন্ধন ডেস্ক। সেখানে সেবা নিতে আসা সবার ফোন নম্বর, ঠিকানা ইত্যাদির মতো ব্যক্তিগত তথ্য জোরে জোরে জানতে চাইছিলেন একজন কর্মী। মনে পড়ল যে আমাদের সমাজে গোপনীয়তা রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অনেকের ধারণা নেই।
শিশুদেরও গোপনীয়তার অধিকার আছে, জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ১৬তম অনুচ্ছেদে সে অধিকার স্বীকৃত। এ বিষয়ে সচেতনতা খুব কম। কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর রোজনামচা পরিবারের সদস্যরা পড়ে ফেলায় সে আত্মহত্যা করেছে, এমন ঘটনার নজির আছে।
এখন প্রতিদিন অসংখ্য মা-বাবা সন্তানের জীবনের সবকিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করছেন। এতে শিশুদের কেমন লাগছে, তার খোঁজ কে রাখে?
ইন্টারনেট ব্যবহার শিশুদের জন্য যাতে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়, তাদের বিকাশে ভূমিকা রাখে এবং মা-বাবা ও বড়দের কারণে তারা যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব
বর্তমানে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এর ইতিবাচক দিক আছে, তবে শিশু সুরক্ষা ও গোপনীয়তা ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
অনলাইন জগতে নানাভাবে শিশুদের ক্ষতি হতে পারে। এর একটি হলো শিশু যৌন নির্যাতনের ছবি বা ভিডিও উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবহার। অনলাইনে ‘গ্রুমিং’ আরেকটি গুরুতর বিষয়, যেখানে একজন নির্যাতনকারী শিশুদের আস্থা অর্জন করার পর তাদের ক্ষতি করে। এ ছাড়া এখানে জঙ্গিবাদ, মাদক, আত্মহত্যাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক বিষয়ে তথ্য তারা পেয়ে যায়।
প্রযুক্তি খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তিত পৃথিবীতে শিশু সুরক্ষার জন্য আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আমরা পিছিয়ে আছি। মা-বাবাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সচেতনতার অভাব রয়েছে।
মা-বাবা না বুঝেই শিশুদের ঝুঁকিতে ফেলছেন
অনেক মা-বাবা সন্তানদের পছন্দ-অপছন্দ, পড়াশোনা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অর্জন, সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। শিশুদের অবস্থান, নাম, জন্মতারিখ, বিদ্যালয়ের নামসহ ব্যক্তিগত তথ্যের প্রকাশ তাদের ঝুঁকির মুখে ফেলে। খারাপ উদ্দেশ্য আছে, এমন কেউ এ তথ্য অপব্যবহার করে নানা ধরনের ক্ষতি করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার ই-সেফটি কমিশনার জানান, পেডোফাইল ইমেজ শেয়ারিং সাইটে তিনি যেসব ছবি পর্যালোচনা করেছেন, তার প্রায় অর্ধেকই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং পারিবারিক ব্লগে মা-বাবার পোস্ট করা। যাঁদের শিশুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে প্রবণতা আছে, তাঁরা এ সাইটগুলোয় ছবি আদান-প্রদান করেন।
শিশুদের সুরক্ষা ও গোপনীয়তা রক্ষায় করণীয়
শিশুরা যাতে অনলাইনে নিরাপদ থাকে, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব মা-বাবার। তাঁদের কোনো আচরণে যাতে সন্তান ঝুঁকির মুখে না পড়ে, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ভিক্টোরিয়া নাশ অনলাইনে শিশুদের নিরাপদ রাখতে মা-বাবার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
শিশুদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রাইভেসি সেটিংস সক্রিয় করতে হবে। শিশুদের তথ্য কোথায় যাচ্ছে এবং কীভাবে তা ব্যবহৃত হচ্ছে, সে সম্পর্কে তাদের জানাতে হবে।
ইন্টারনেট থেকে ছবি বা ভিডিও মুছে ফেললেও তা কোনো আর্কাইভ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেখা যেতে পারে, অথবা কেউ হয়তো স্ক্রিনশট নিয়ে রাখতে পারে। এই বিষয়ে সন্তানদের মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। সন্তান কী কী অ্যাপস, গেম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে, সে সম্পর্কে মা-বাবার জানা দরকার। সন্তানদের নিয়ে কিছু পোস্ট করার আগে ভাবতে হবে।
ওপরের পরামর্শগুলো মেনে চলার পাশাপাশি মা-বাবাকে বিবেচনা করতে হবে যে তাঁদের পোস্টের কারণে সন্তানেরা ভবিষ্যতে লজ্জিত, বিব্রত, উদ্বিগ্ন বা বিরক্ত হবে কি না। এতে সন্তানের কোনো ক্ষতি হতে পারে কি?
পোস্ট দেখে যাতে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার রুটিন সম্পর্কে কেউ জানতে না পারে, তা খেয়াল রাখাটা জরুরি। জিওট্যাগিং (যার মাধ্যমে ইন্টারনেটে একজন ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়) বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি সেটিংস এমন হবে, যাতে পোস্টগুলো শুধু বিশ্বস্ত বন্ধু ও পরিবারের সদস্যরা দেখতে পারেন। তাঁরা যাতে এই পোস্ট শেয়ার না করেন, তা বলে দিতে হবে।
মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ
অনলাইনের কার্যক্রম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তব জীবনের প্রতিফলন। মা-বাবা যদি সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটান, তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং আগ্রহের বিষয়, বন্ধুবান্ধব ইত্যাদিসহ তাদের জীবন সম্পর্কে জানেন, তবে তাঁরা বাস্তব জগৎ এবং অনলাইনের জন্য সঠিক নির্দেশনা ও সহায়তা দিতে সক্ষম হবেন।
সন্তানদের সামাজিক ও আবেগীয় দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করা, তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা, ডিভাইসগুলো ঘরের উন্মুক্ত স্থানে ব্যবহার করতে বলা, ডিভাইস ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া যেকোনো মা-বাবা করতে পারেন। এর জন্য প্রযুক্তি বিষয়ে খুব বেশি জানার প্রয়োজন নেই।
অনলাইনের অভিজ্ঞতা শিশুদের জন্য ইতিবাচক হোক
রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনলাইনে শিশু সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে অনলাইনে শিশু সুরক্ষায় প্রাসঙ্গিক আইনগুলোর সমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন, এর মধ্যে আছে শিশু আইন ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৮), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩); ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ এবং পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২।
ইন্টারনেট সেবা সরবরাহকারী, মুঠোফোন কোম্পানিসহ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে পণ্য তৈরি এবং সেবাদানের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা করতে হবে।
অনলাইনে তথ্য পাওয়া এবং মতামত প্রকাশের সময় যাতে শিশুরা সুরক্ষিত থাকে, সে জন্য একধরনের ভারসাম্য প্রয়োজন। ইন্টারনেট ব্যবহার শিশুদের জন্য যাতে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়, তাদের বিকাশে ভূমিকা রাখে এবং মা-বাবা ও বড়দের কারণে তারা যাতে ঝুঁকিতে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।
শিশুরা স্বতন্ত্র ব্যক্তি। তাদের গোপনীয়তার অধিকার আছে। শিশু সংবেদনশীল মন নিয়ে এই বিষয় সবাইকে বোঝাতে হবে।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী