দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই প্যারিসে নির্বাসিত হওয়া পোলিশ বুদ্ধিজীবী জার্জি গিয়েড্রয়েক (তিনি ছিলেন মূলত লিথুয়ানিয়ান বংশোদ্ভূত, জন্মেছিলেন মিনস্কে) একটি কথা চালু করেছিলেন। তাঁর সেই কথাটিকে পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের বিষয়ে পোল্যান্ডের অনুসৃত নীতিকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কথাটি হলো: ‘স্বাধীন বেলারুশ, স্বাধীন লিথুয়ানিয়া ও স্বাধীন ইউক্রেন ছাড়া স্বাধীন পোল্যান্ড বলে কিছু থাকতে পারে না।’
সমাজতন্ত্রের পতনের পর থেকে ওয়ারশ এটিকে কূটনৈতিক মূলমন্ত্র হিসেবে নিয়েছে। ইউক্রেনের যে দেশপ্রেমিক নাগরিকেরা দেশটির বর্তমান নীতিগুলোকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, তাঁরাও একইভাবে এটি মনে করে থাকেন। এটি সবাই বুঝতে পারছে, রাশিয়ার দখল করে নেওয়া ভূমির সবটাও যদি ইউক্রেন পুনরুদ্ধার করে, তাহলেও প্রতিবেশী বেলারুশে স্বৈরাচার আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কো যত দিন তাঁর অপশাসন চালাবেন, তত দিন পোলিশ ও ইউক্রেনীয় নাগরিকেরা প্রকৃত সুরক্ষার স্বাদ উপলব্ধি করতে পারবে না।
সুতরাং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রশাসন এবং বেলারুশিয়ান বিরোধীদের জোট বাধাটা অনস্বীকার্য। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সে ধরনের কোনো জোট তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে তো পারেইনি, উল্টো ইউক্রেনের কিছু নেতা তাঁদের সম্ভাব্য অংশীদারদের খারিজ করে দিচ্ছেন।
এ বছর শান্তিতে নোবেল জয়ী হিসেবে বেলারুশের মানবাধিকার আইনজীবী আলেস বিলিয়াতস্কি, রাশিয়ার বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) মেমোরিয়াল এবং ইউক্রেনের বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিজ-এর নাম ঘোষণা করার পর প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা মিখাইলো পোডোলিয়াকের প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকান।
নোবেল কমিটির ঘোষণার পর তিনি টুইট করেছেন, ‘নোবেল কমিটির কাছে “শান্তি” শব্দটির একটি অন্য ধরনের মানে আছে; কারণ পুরস্কার পাওয়া তিনটি পক্ষের মধ্যে একটি পক্ষ আক্রান্ত এবং বাকি দুটি পক্ষ আক্রমণকারী দুটি দেশের প্রতিনিধি। পুরস্কারপ্রাপ্ত রাশিয়ান বা বেলারুশিয়ান কোনো সংস্থাই (পুতিনের) যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি।’
একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার এ ধরনের বাজে কথা ইউক্রেনের স্বার্থকে শুধু ক্ষতিগ্রস্তই করতে পারে। পুতিনের রাশিয়ার ‘প্রতিনিধি’ হওয়া তো অনেক দূরের কথা, ‘মেমোরিয়াল’ নামের এনজিওটি পুতিন সরকারের ঘোর বিরোধিতা করে আসছিল। কমিউনিস্ট যুগের অপরাধগুলো বের করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থাকে গত বছর ক্রেমলিন বন্ধ করে দিয়েছে।
বেলারুশের গণতন্ত্রপন্থী মানুষগুলোর সেই সাহসিকতাকে সম্মান করার এবং পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে উঠলে আবার তাদের জেগে উঠতে অনুপ্রাণিত করার বদলে পোডোলিয়াকের মতো কিছু ইউক্রেনীয় তাদের কাপুরুষ ও ক্ষমতাসীনদের দালাল বলে অভিযুক্ত করছেন। বিদেশেও বেলারুশ থেকে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে তাঁরা রাশিয়ানদের মতো আচরণ করেন।
আর বেলারুশের ভিন্নমতাবলম্বী অধিকারকর্মী বিলিয়াতস্কির সংস্থা ভিয়াসনা দুই দশকের বেশি সময় ধরে একনায়ক লুকাশেঙ্কোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বিলিয়াতস্কি নিজে এক বছরের বেশি সময় ধরে বেলারুশের কারাগারে বন্দী আছেন। রাশিয়ার আক্রমণের বিরোধিতা করার জন্য তাঁর কি লোকজনকে সংগঠিত করার কথা ছিল?
পোডোলিয়াকের বিভক্তি সৃষ্টিকারী বক্তব্য এমন একটি বিশদ বিষয়কে চিত্রিত করে যার সুদূরপ্রসারী পরিণতি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ান নিপীড়নের শিকার হওয়া ইউক্রেনীয় এবং বেলারুশিয়ানদের মধ্যে বিভক্তি ও উত্তেজনা বাড়তে পারে। আদতে ইউক্রেনীয়দের শ্রেষ্ঠত্বের ক্রমবর্ধমান অনুভূতিই এখন মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৪ সালে ইউক্রেনীয়রা তাদের দেশের রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। অন্যদিকে, বেলারুশিয়ানরা ২০২০ সালে কারসাজির নির্বাচনের পর লুকাশেঙ্কোকে গদি থেকে নামানোর চেষ্টা করেও পারেনি এবং যুদ্ধ শুরু হতেই লুকাশেঙ্কো বেলারুশে সব ধরনের বিক্ষোভ দমন করে ফেলেন। এ বিবেচনায় ইউক্রেনের লোকেরা নিজেদের বেলারুশিয়ানদের চেয়ে উন্নত শ্রেণির বলে ভাবতে শুরু করে।
কিন্তু এ যুক্তি ন্যায্য নয়। কারণ, ইউক্রেনের গণতন্ত্রপন্থীদের হাতে যে রকম গোটা দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল, বেলারুশিয়ান বিরোধীদের হাতে কখনোই তা ছিল না, স্থানীয় সরকার কিংবা পার্লামেন্টের ওপর তাদের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণও ছিল না। লুকাশেঙ্কো সেখানে একটি সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র গড়ে তুলেছেন। বরং এটি একটি অলৌকিক ঘটনা ছিল যে ২০২০ সালে বেলারুশিয়ানরা ব্যাপক বিক্ষোভ করতে সক্ষম হয়েছিল।
বেলারুশের গণতন্ত্রপন্থী মানুষগুলোর সেই সাহসিকতাকে সম্মান করার এবং পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে উঠলে আবার তাদের জেগে উঠতে অনুপ্রাণিত করার বদলে পোডোলিয়াকের মতো কিছু ইউক্রেনীয় তাদের কাপুরুষ ও ক্ষমতাসীনদের দালাল বলে অভিযুক্ত করছেন। বিদেশেও বেলারুশ থেকে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে তাঁরা রাশিয়ানদের মতো আচরণ করেন।
বেলারুশিয়ানদের প্রতি এ ধরনের ঘৃণা প্রকাশ শুধু অনৈতিক নয়; এটা রাজনৈতিকভাবেও নির্বোধের আচরণ। বেলারুশিয়ান বিরোধীদের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের মুক্তির আন্দোলনে সঙ্গে থাকা ইউক্রেনীয়, পোল এবং ওই অঞ্চলজুড়ে অন্যদের কর্তব্য।
কারণ, বেলারুশে এখন লুকাশেঙ্কোর যে সরকার রয়েছে, তারা ইউক্রেন আক্রমণে সরাসরি রাশিয়াকে সহযোগিতা করছে। এ কারণে ইউক্রেন যদি রাশিয়ার হাত থেকে বেদখল হওয়া ভূখণ্ডের সবটাও ফেরত আনে, তারপরও ইউক্রেন নিরাপদ থাকতে পারবে না।
তাকে সুরক্ষিত হতে হলে বেলারুশের ক্ষমতা থেকে পুতিনপন্থী লুকাশেঙ্কোকে ক্ষমতাচ্যুত করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে বেলারুশের মানুষের সঙ্গে ইউক্রেনের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিভক্তি ঘটানো আত্মঘাতী হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্লাভমির সিয়েরাকোভস্কি জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের একজন সিনিয়র ফেলো