যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টকে যেভাবে সামলাবে চীন

নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে জল্পনা বাড়ছেছবি: রয়টার্স

ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি কমলা হ্যারিস? কে জিতবেন? এই নিয়ে যখন বাকি বিশ্ব চিন্তিত, তখন এই দুই প্রার্থীকে চীন গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে।

যদিও প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, দুই প্রার্থীর কেউই যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সরাসরি সংঘাত চান না; কারণ এটি বিশ্বকে বিশৃঙ্খলার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

চীনা নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প বা কমলা যিনিই জিতুন, বাণিজ্য, প্রযুক্তি এবং তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বিতণ্ডা আরও তিক্ত হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপের দিকে যাবে—এমনটা ধরে নিয়েই চীন সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ লক্ষ্যে তারা দেশজুড়ে একটি সমন্বিত পদ্ধতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর মানে হলো, যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলায় চীন এখন কেবল পররাষ্ট্রনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকছে না। তারা এখন তার দেশের অর্থনীতি, সামরিক বাহিনী ও প্রযুক্তি খাতের নেতাদের সঙ্গে কাজ করছে; দেশের সব সম্পদকে কাজে লাগানোর কথা ভাবছে।

চীনকে দমিয়ে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যেসব পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, সেগুলোই চীনকে এ ধরনের কৌশল গ্রহণ করতে প্রভাবিত করেছে। চীন স্পষ্টতই বুঝতে পারছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের প্রভাব কমাতে এবং নিজেদের প্রযুক্তিগত আধিপত্য ধরে রাখতে চায়।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক বাজারে চীনের প্রবেশ কমাতে এবং এশিয়া ও অন্য অঞ্চলে ‘চীনের চ্যালেঞ্জ’ মোকাবিলা করতে মিত্রদের নিয়ে জোট তৈরি করছে। অবরোধের মুখে চীন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি টক্কর দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।

যুক্তরাষ্ট্র চীনকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে চাইছে—এমন একটি ধারণা থেকে বেইজিং দীর্ঘ মেয়াদে ওয়াশিংটনের সঙ্গে শত্রুতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

এর অংশ হিসেবে চীন তার কৌশলগত অগ্রাধিকারগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। এর আগে চীন যেকোনো মূল্যে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিত। সেখান থেকে সরে এসে তারা এখন উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার দিকে মন দিচ্ছে।

যদিও মার্কিন-চীন রশি–টানাটানি রাতারাতি শেষ হয়ে যাবে না; তবু আশা করা যায়, বিশ্বের এই দুই বৃহত্তম অর্থনীতি সংঘর্ষ এড়াতে সক্ষম হবে; আগামী বছর হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প কিংবা কমলা যিনিই আসুন না কেন।

অভ্যন্তরীণ উদ্ভাবনকে বিকশিত করার পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করছেন, যাতে অস্থাবর সম্পত্তি খাতের ওপর সরকারের নির্ভরশীলতা কমে যায়।

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) সম্প্রতি সমাপ্ত ২০তম কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় অধিবেশন এই বিশাল সংস্কারের প্রস্তাবকে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে।

বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিকশিত করা চিন পিংয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত লক্ষ্য।

চীন উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে আসছে এবং নির্দিষ্ট কিছু প্রযুক্তি খাতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব লাভ করার বিষয়ে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

কিন্তু চীনের প্রধান প্রধান প্রযুক্তি কোম্পানি এবং প্রযুক্তি ব্যক্তিত্বকে নিশানা করে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে চীনের এই চেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে।

ধারণা করা হচ্ছে, বিশেষ করে চীনের প্রযুক্তি খাতের রাশ টেনে ধরতে যুক্তরাষ্ট্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

ঐতিহ্যগতভাবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে চীন-আমেরিকা সম্পর্কের স্থিতিশীলতার বড় শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে চীনা নেতারা এখন এগুলোর ওপর কম গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা বাড়ার পাশাপাশি চীন ইতিমধ্যেই একটি নিম্নমানের রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি মডেল থেকে উচ্চমানের প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

ইলেকট্রিক যানবাহন এবং সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে চীনের দ্রুত অগ্রগতি বেইজিংয়ের সঙ্গে ওয়াশিংটনের বাণিজ্য উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তবে তাইওয়ান এখনো যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল ইস্যু হিসেবে কাজ করছে।

এটি সত্য যে তাইওয়ান নিয়ে চীন তার অনুসৃত নীতির ভাষায় কোনো আনুষ্ঠানিক পরিবর্তন আনেনি। তবে চীনা কৌশলবিদেরা তাইওয়ানের নতুন স্বাধীনতাপন্থী সরকারকে বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন।

এর ফলে সম্ভবত চীন তাইওয়ানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আগের চেয়ে কড়া অবস্থানে যাবে; এমনকি এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আরও সক্রিয় প্রতিরোধে চলে যেতে পারে।

একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ আরও কড়া করতে পারে। কারণ, তাইওয়ান প্রণালিতে এই দুই পক্ষের সংঘর্ষের উপাদানগুলো আগে থেকে তৈরি হয়েই আছে।

নভেম্বর মাসে মার্কিন ভোটাররা যাঁকেই নির্বাচন করুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকা তিক্ত সম্পর্ককে আরও খারাপ জায়গায় যাওয়া থেকে ফেরাতে তাঁর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নিয়মিত সামনাসামনি আলোচনা করা উচিত হবে।

চীন-মার্কিন সম্পর্ক আরও খারাপ অবস্থায় যদি যায়, তাহলেও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে না—এটি নিশ্চিত করাই এখন বেইজিংয়ের প্রধান লক্ষ্য। কারণ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই জনগণের কাছে চীনের বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকার বৈধতার মূল ভিত্তি।

এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে চীনের নীতিনির্ধারকেরা বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে বৈশ্বিক দক্ষিণে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বাড়িয়েছে।

এটি চীনের জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি করার এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গতি বাড়ানোর সুযোগ এনে দিতে পারে।

ট্রাম্প ও হ্যারিস নির্বাচনের আগে চীন প্রশ্নে কঠোর মনোভাব দেখানোয় যেভাবে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, তা দেখে চীনা নীতিনির্ধারকদের এখন সংশয় নেই যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকা তাদের টালমাটাল সম্পর্ক অদূর ভবিষ্যতে আরও নাজুক অবস্থায় যাবে।

তবে এটিও ঠিক, মার্কিন-চীন সম্পর্ককে অতিরিক্ত নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে চীন যে নীতি অনুসরণ করে থাকে, তা সব সময়ই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং দেশের নিজস্ব প্রয়োজনের ভিত্তিতে ঠিক করা হয়। একটি ভারসাম্যপূর্ণ পর্যালোচনার মাধ্যমে তারা বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক কেমন হবে, তা ঠিক করেন।

সি চিন পিংয়ের অধীনে চীনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় পরিবর্তন হয়েছে; কিন্তু তার পরেও চীনের এই নীতির পরিবর্তন হয়নি।

আশার কথা, সম্প্রতি উভয় পক্ষই দায়িত্বশীলভাবে সম্পর্ক ঠিক রাখার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।

যদিও মার্কিন-চীন রশি–টানাটানি রাতারাতি শেষ হয়ে যাবে না; তবু আশা করা যায়, বিশ্বের এই দুই বৃহত্তম অর্থনীতি সংঘর্ষ এড়াতে সক্ষম হবে; আগামী বছর হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প কিংবা কমলা যিনিই আসুন না কেন।

  • ইউ জিয়ে চ্যাটাম হাউসের এশিয়া-প্যাসিফিক প্রোগ্রামে চীন বিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ সারফুদ্দিন আহমেদ