সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ড কি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে

হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারফাইল ছবি: রয়টার্স

হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের লাশের যে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রথম ছড়িয়ে পড়ে, সেটি দেখে গাজার একটি আংশিকভাবে ধ্বংস হওয়া বাড়ির ভেতর থেকে তোলা ছবি বলে মনে হচ্ছিল। ইসরায়েলি নেতারা হয়তো বিশ্বকে এই ছবি দেখাতে চাননি।

ধারণা করা হচ্ছে, যিনি প্রথম লাশটি দেখেন, তিনিই তাড়াহুড়ো করে ছবিটি তুলে পরিচিতজনদের কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করার পর ছবিটি বাকি বিশ্ব দেখতে পায়।

সিনওয়ারের মৃত্যু কীভাবে ঘটেছিল, তা দেখানোর জন্য সম্ভবত ইসরায়েলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাথায় অন্য একটি গল্প ছিল। তাঁরা হয়তো এই গল্প ফাঁদতে চেয়েছিলেন যে হামাসপ্রধান কাপুরুষের মতো সুড়ঙ্গে লুকিয়ে ছিলেন এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। তবে সত্যটি হলো, হামাসের এই শীর্ষ নেতা বীরের মতো শত্রুদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করে শহীদ হয়েছেন।

ছবিতে সিনওয়ারের মাথায় বুলেটের ক্ষত দেখা গেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বিশ্বকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন, সিনওয়ার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু না; তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন না; বরং তিনি ইসরায়েলি সেনাদের মুখোমুখি হয়ে লড়াই করে মারা যান।

ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সিনওয়ারের মৃত্যু মূলত শাহাদাত বরণ বা সবচেয়ে মহৎ ও সম্মানজনক মৃত্যু হিসেবে বিবেচিত হবে।

ইয়াহিয়া সিনওয়ার সর্বার্থেই ফিলিস্তিনি মুক্তিকামীদের অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে গাজার খান ইউনিস শরণার্থীশিবিরে তিনি জন্ম নেন। তাঁর পরিবার ইসরায়েলের দখলদারদের তাড়া খেয়ে ফিলিস্তিনের মজদাল শহর থেকে এখানে এসেছিল।

সিনওয়ার গাজার একটি স্কুলে ও ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছিলেন। ওই সময়টাতে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি শাখায় যোগ দেন। ১৯৮২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি প্রথমবার ইসরায়েলিদের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে ১০ মাস জেল খাটেন। ১৯৮৫ সালে আবার তিনি আট মাসের জন্য জেলে গিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সিনওয়ার হামাসের অন্যতম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ওই সময় হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমদ ইয়াসিন তাঁকে নিরাপত্তা বিভাগ ‘মজদ’ গঠনের দায়িত্ব দেন। এই ‘মজদ’-এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলি বাহিনীর হয়ে কাজ করা ফিলিস্তিনিদের শনাক্ত করা, ধাওয়া করা ও শাস্তি দেওয়া।

১৯৮৮ সালে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। সে দফায় তাঁকে এবং দুজন ইসরায়েলি সেনাকে অপহরণ ও হত্যা এবং ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরের কাজ করা চারজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করার অভিযোগে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

সিনওয়ার ২০২১ সালে গাজায় হামাসের স্থানীয় সংগঠনের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর আরও বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। সেই বছরই জেরুজালেমের ইহুদি বসতির লোকেরা কয়েক দফায় আল-আকসা মসজিদে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন এবং আল–আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশে ইসরায়েলি বিধিনিষেধের কারণে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। এর জেরে গাজায় ১১ দিনের একটি যুদ্ধ হয়েছিল।

২৩ বছর ইসরায়েলি কারাগারে কাটানোর সময় তিনি হিব্রু শেখেন এবং বেশ কটি বই অনুবাদ ও রচনা করেন।

২০১১ সালে গিলাদ শালিত নামের এক ইসরায়েলি সেনার মুক্তির বিনিময়ে যে এক হাজার ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, সিনওয়ার ছিলেন তাঁদের একজন। মুক্তি পাওয়ার পর সিনওয়ার হামাসের সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেডের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এর পরের বছর তিনি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন।

সিনওয়ার ২০২১ সালে গাজায় হামাসের স্থানীয় সংগঠনের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর আরও বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। সেই বছরই জেরুজালেমের ইহুদি বসতির লোকেরা কয়েক দফায় আল-আকসা মসজিদে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন এবং আল–আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশে ইসরায়েলি বিধিনিষেধের কারণে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যায়। এর জেরে গাজায় ১১ দিনের একটি যুদ্ধ হয়েছিল।

এটি ছিল ১৪ বছরের মধ্যে ইসরায়েলের চতুর্থ বড় আক্রমণ। সেবার অনেক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় এবং শত শত প্রাণহানি ঘটে। তবে এই যুদ্ধ সিনওয়ারকে গাজার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

আরও পড়ুন

নিউইয়র্ক টাইমসের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইসরায়েলিরা গাজায় একটি ল্যাপটপ থেকে হামাসের কিছু নথি খুঁজে পেয়েছিলেন। সেখানে দাবি করা হয়েছে, সিনওয়ার ও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ২০২১ সালের শুরু থেকেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি বড় আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

গত ৩১ জুলাই তেহরানে ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করার পর গত ৫ আগস্ট হামাসের শুরা কাউন্সিল সিনওয়ারকে হামাসের নতুন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ঘোষণা করে। এটি অনেককে অবাক করেছিল।

সাধারণত হামাসের প্রধান হিসেবে কোনো প্রবাসী সদস্যকে করা হয়ে আসছে, যাতে সেই নেতা অবাধে চলাচল করতে পারেন এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারেন।

অনেকেই ভেবেছিলেন খালেদ মেশাল এই পদে নিযুক্ত হবেন। কিন্তু মেশাল এই পদ নিতে অস্বীকার করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, ‘যেহেতু গাজা ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করছে, তাই এ সময়ে গাজায় অবস্থানরত কাউকেই এই আন্দোলনের নেতৃত্বে আনা দরকার।’

যদিও সিনওয়ারের হত্যাকে হামাসের জন্য আরেকটি বড় আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে, তবে হামাসের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলে এর কোনো উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই।

ইসরায়েল অতীতে বহুবার হামাসের নেতৃত্বকে প্রায় ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু কখনো তাদের সংকল্পকে দুর্বল করতে পারেনি; বরং সে সংকল্প দৃঢ়ই থেকে গেছে।

হামাসের দৃঢ়তার কারণ দুটি। প্রথমত, হামাস একটি ভাবাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে। সেই ধারণা হলো, ফিলিস্তিনিরা একসময় তাঁদের স্বদেশে বাস করতেন এবং সেই স্বদেশ তাঁদের কাছে থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় কারণ হলো, হামাস একটি প্রাতিষ্ঠানিক আন্দোলন, যেখানে নির্বাচিত নেতৃত্ব থাকে। এটি কোনো ব্যক্তিপূজা বা একক নেতার ওপর নির্ভরশীল নয়। নেতারা মারা গেলে দ্রুতই তাঁদের জায়গায় নতুন নেতাকে বসানো হয়।

এখন দেখা যাক, সিনওয়ারের উত্তরসূরি কে হতে পারেন। সম্ভবত এবার প্রবাসে থাকা কেউই এই পদ গ্রহণ করবেন। অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব ঠিক না করা পর্যন্ত আন্দোলনটি হয়তো সাময়িকভাবে একজন উপনেতার অধীনে পরিচালিত হবে। তবে যুদ্ধ চলাকালীন নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

এতে অবশ্য হামাসের দমে যাওয়ার কারণ নেই। কারণ, ইসলামি সংস্কৃতিতে শহীদ হওয়া কোনো ক্ষতি নয়; বরং এটি একটি অর্জন।

সিনওয়ার অনেকের কাছেই একজন মহান শহীদ হিসেবে বিবেচিত হবেন।

প্রশ্ন উঠছে, সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ড কি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে?

উত্তর হলো: যুদ্ধ শেষ হতে পারে, যদি ইসরায়েল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রস্তাব করা যুদ্ধবিরতির শর্ত (যা হামাস মেনে নিয়েছে) মেনে নেয়। তবে যদি নেতানিয়াহু হামাসকে ধ্বংস করার এবং বিনিময়ে কিছু না দিয়ে জিম্মিদের মুক্ত করার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তাহলে শিগগিরই যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

সমস্যা হলো, সিনওয়ারের শহীদ হওয়াটা নেতানিয়াহুকে আরও সাহসী করে তুলতে পারে। এটি তাঁকে ইরানে আঘাত হানতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আর ইসরায়েল ইরানে হামলা করে বসলে যুদ্ধ সম্ভবত আরও বিস্তৃত ও তীব্র হবে।

  • আজাম তামিমি একজন ব্রিটিশ-ফিলিস্তিনি শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক কর্মী।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ