যথার্থ গুরুদক্ষিণা দিয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা অঞ্জন দত্ত। গুরুর জন্মশতবার্ষিকীতে ভক্তিতে বিগলিত হয়ে নয়, বরং তাঁকে নিয়ে একটি ছবি বানিয়ে গুরুর প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান জানিয়েছেন তিনি; বলছি অঞ্জন দত্ত পরিচালিত ও অভিনীত ‘চালচিত্র এখন’ ছবিটির কথা।
১৯৮১ সালে এক বিক্ষুব্ধ যুবক অঞ্জন দত্তকে ‘চালচিত্র’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য বাছাই করেছিলেন মৃণাল সেন; গুরুদক্ষিণা দিতে সেই ঘটনা নিয়ে আস্ত এক সিনেমা বানিয়ে ফেলেছেন তিনি।
সিনেমায় দেখা যায় বা অঞ্জন দত্তর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানা যায়, ১৯৮১ সালে তিনি খুব ভালো অবস্থায় ছিলেন না। তখন তিনি রক সংগীত করেন; নাটকের একটি দলও ছিল তাঁর নেতৃত্বে। সদ্য বিয়ে করেছেন। কী করবেন না করবেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। সেই সঙ্গে ছিল জার্মানি যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।
তিনি তখন অস্তিত্ববাদী হিসেবে পরিচয় দিতেন; জ্যাঁ পল সার্ত্রে ও আলবেয়্যার কামু তাঁর প্রিয় লেখক। তিনি মোটেও কমিউনিস্ট ছিলেন না, যদিও সেই সময় পশ্চিম বাংলায় কমিউনিস্ট শাসন চলছে, তাদের প্রভাবও সর্বব্যাপক। মৃণাল সেন কমিউনিস্ট চলচ্চিত্রকার হিসেবে খ্যাত।
ঠিক তেমন একটি সময় মৃণাল সেন তাঁকে ‘চালচিত্র’ ছবিটির জন্য মনোনীত করেন। মৃণাল সেন তখন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রকার; তাঁকে ‘না’ করার মতো অবস্থা অঞ্জন দত্তর ছিল না। কেন ‘হ্যাঁ’ বলবেন, সে যুক্তিও পরিষ্কার ছিল না। আবার খেয়ালি ও খ্যাপাটে মৃণাল সেনের সবকিছু তাঁর ঠিক মনঃপূত হচ্ছিল না। এ নিয়ে তাঁর মধ্যে তখন চলছে নিরন্তর দ্বন্দ্ব। ঠিক সেই বাস্তবতাই এ ছবিতে উঠে এসেছে। তাঁর সঙ্গে মৃণাল সেনের অনেকটা লাভ অ্যান্ড হেট সম্পর্ক নিয়েই এ সিনেমা আবর্তিত হয়েছে।
‘আই লাভ ক্যালকাটা; আই হেট ক্যালকাটা; আই অ্যাম এক্সসাইটেড অ্যাবাউট ক্যালকাটা/ আই অ্যাম ডিজঅ্যাপয়েন্টেড অ্যাবাউট ক্যালকাটা; আই অ্যাম ইরিটেটেড বাই ক্যালকাটা; আই অ্যাম ফোসিনেটেড বাই ক্যালকাটা; ক্যালকাটা ইজ মাই এলডোরাডো’– মৃণাল সেন যে তাঁকে পিতৃস্নেহে আগলে রেখেছেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে কলকাতাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, সেটাই সম্ভবত অঞ্জন দত্তর সবচেয়ে বড় পাওনা।
সিনেমায় দেখা যায়, রঞ্জনরূপী অঞ্জন দত্ত একবার স্টেটসম্যান পত্রিকার হয়ে ফিচারের জন্য মৃণাল সেনের মন্তব্য নিতে এলে তিনি উল্লিখিত কথা বলেন। এমন কথা তো মৃণাল সেনের মুখেই মানায়, তিনি যে মহানগরীর মরা পাথরেও প্রাণ খোঁজা মানুষ। তিনি যেন শার্ল বোদলেয়ার, পঙ্কের মধ্যেও যিনি ফোটাতে চেয়েছিলেন পদ্ম।
রঞ্জন এ কথা বলেন এক গলির মধ্যে। ‘দারুণ’ কথাটা বলার পর রঞ্জনরূপী কুনাল এক দৌড়ে গলি থেকে বেরিয়ে যান; এরপর নদীতে এক বালকের ঝাঁপ দেওয়ার দৃশ্য। এই দৃশ্যায়নের প্রতীকী মূল্য আছে—রঞ্জন যেন ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বৃহত্তর জগতে প্রবেশ করলেন। এর মধ্য দিয়ে সেই বিতর্কেরও প্রতীকী অবসান হলো, অর্থাৎ ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে শেষবিচারে ভেদাভেদ নেই। নদীতে সেই বালকের ঝাঁপ দেওয়ার দৃশ্য যেন রঞ্জনের নতুন জীবনে প্রবেশ করার প্রতীক, নদীতে অবগাহন করে নতুন জীবনের সন্ধান লাভ।
সিনেমার একটি দৃশ্যে তিনি বলেন, প্রথম যখন এই শহরে আসি, তখন তার বিশালত্বের সামনে রীতিমতো নতজানু হয়ে যাই। জবাবে রঞ্জনরূপী অঞ্জন দত্ত বলেন, এখন তো আর সে রকম নেই; সময় বদলে গেছে। কুনাল সেনরূপী মৃণাল সেন বলেন, হ্যাঁ পাল্টেছে, বড় বড় ভবন হয়েছে; সরকার পাল্টেছে; কিন্তু কলকাতার বিশৃঙ্খলার মজাটা একই রকম আছে। অর্থাৎ সবকিছুর মধ্যে তিনি মানবিক গল্পটা খুঁজে পেতে সিদ্ধহস্ত, যে বিষয়টি এখন একেবারে অনুপস্থিত বলে অভিযোগ করেন পরিণত অঞ্জন দত্ত।
তবে সিনেমাটি তৈরির মধ্যে একধরনের তাড়াহুড়ার ছাপ আছে। অনেক দৃশ্য দেখে ১৯৮০ সালের কলকাতার জায়গায় সমসাময়িক কলকাতার কথাই মনে হয়েছে। কিন্তু মৃণাল সেনের সেই খামখেয়ালি, তাঁর চলনবলন, কলাকুশলীদের প্রতি তাঁর খেয়াল—সবকিছু পরম নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে তুলে এনেছেন অঞ্জন দত্ত। সিনেমা দেখে কখনোই মনে হয়নি, পর্দার কুনাল সেন প্রকৃত মৃণাল সেন নন।
মৃণাল সেন ও অঞ্জন দত্তর সম্পর্কের রসায়ন নিছক মুগ্ধতার ছিল না। স্পষ্টত তাঁরা দুজন তখনকার দুই বিপরীত মেরুর দর্শনের মানুষ। মৃণাল সেন কমিউনিস্ট আর অঞ্জন দত্ত অস্তিত্ববাদী। মার্ক্সবাদে যেখানে ব্যক্তির ওপরে সমষ্টিকে স্থান দেয়, সেখানে অস্তিত্ববাদের মূল কথা হলো সাধারণ সত্তা নয়, ব্যক্তিসত্তাই সবার আগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বড় ধরনের অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায় মানুষের জীবন। চরম শূন্যতা ভর করে মানুষের জীবনে।
বিশ্বযুদ্ধের দামামায় সব যখন লন্ডভন্ড অবস্থা, তখন অস্তিত্ববাদ একভাবে মানুষের জীবনে আশার সঞ্চার করে, কেননা অস্তিত্ববাদ মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। জ্যাঁ পল সার্ত্রে তাঁর ‘বিং অ্যান্ড নাথিংনেস’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবে বলেন, মানুষ অপূর্ণ, মানুষ তার পূর্ণতার জন্য ছুটে চলে। আর এই পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য মানুষের স্বাধীনতা অপরিহার্য। অস্তিত্ববাদীরা ব্যক্তিস্বাধীনতার জয়গান গেয়েছেন। অঞ্জন দত্ত এই ধারার অনুসারী।
‘চালচিত্র এখন’ ছবিতে দেখা যায়, এ নিয়ে কুনাল সেনরূপী মৃণাল সেন ও রঞ্জনরূপী অঞ্জন দত্তর মধ্যে বাহাস হচ্ছে। মার্ক্সবাদ, সামষ্টিকতা ছাড়া যে মানুষের অস্তিত্বের সমস্যার সমাধান হতে পারে না, সেটাই কুনাল সেনের মূল বক্তব্য। রঞ্জন সামষ্টিকতায় একবারে অবিশ্বাস না করলেও দল বা পার্টিবিরোধী। তাঁর বক্তব্য, এসবই একধরনের ক্ষমতা; যে ক্ষমতা শেষমেশ মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে।
‘চালচিত্র’ ছবিটি তখনকার নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের জীবনসংগ্রাম নিয়ে তৈরি; তখন এই শ্রেণির মানুষকে কয়লার চুলায় রান্না করতে হতো। গ্যাসের চুলা তাঁদের নাগালের বাইরে। সিনেমার মূল চরিত্রের বসবাস এক বারোয়ারি বাড়িতে। সেই বাড়ির উঠানে শেওলা পড়ে গেছে; প্রতিদিন কেউ না কেউ আছাড় খাচ্ছে। একদিন রাগের মাথায় সবাই মিলে উঠান পরিষ্কার করে ফেলল। সিনেমার এই দৃশ্যের প্রসঙ্গ টেনে কুনাল সেন রাগী তরুণ রঞ্জনকে বলেন, এটা কি ব্যক্তি না সমষ্টি। এভাবে দৈনন্দিন জীবনের নজির টেনে কুনাল সেনরূপী মৃণাল সেন বড় এক দার্শনিক বিতর্কের ইতি টানেন।
সিনেমার শেষ দৃশ্যে চলে আসা যাক। ‘চালচিত্র’ সিনেমার শুটিং শেষ হয়ে গেছে; রঞ্জনরূপী অঞ্জন দত্ত আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছেন। তিনি কুনাল সেনরূপী মৃণাল সেনকে জিজ্ঞাসা করছেন, তিনি কী করবেন; জার্মানিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, সেখানেও যেতে ইচ্ছা করছে না।
কুনাল সেনের সঙ্গে অনেকে তর্কবিতর্ক করলেও তাঁর প্রতি টান তৈরি হয়ে গেছে রঞ্জনের। বলছেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই অ্যাক্টিং না করলেও; আপনার বাড়িটা খুব সুন্দর। এই বলে কুনাল সেনকে জড়িয়ে ধরে রঞ্জন; তাঁর চোখে তখন অবিরাম অশ্রুধারা। কুনাল সেন বলেন, কাঁদো, কাঁদো; কেঁদে হালকা হও; এরপর তোমাকে একটা প্রশ্ন করব। কুনাল সেনের প্রশ্নটা হলো, কলকাতা কেমন লাগছে? এরপর তাঁদের মধ্যে আরও কথোপকথন হচ্ছে এবং একদম শেষ পর্যায়ে কুনাল সেন বলছেন, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না কিন্তু—কলকাতা কেমন লাগছে, তোমার শহর?’ দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রঞ্জন বলে, ‘দারুণ!’
রঞ্জন এ কথা বলেন এক গলির মধ্যে। ‘দারুণ’ কথাটা বলার পর রঞ্জনরূপী অঞ্জন এক দৌড়ে গলি থেকে বেরিয়ে যান; এরপর নদীতে এক বালকের ঝাঁপ দেওয়ার দৃশ্য। এই দৃশ্যায়নের প্রতীকী মূল্য আছে—রঞ্জন যেন অস্তিত্ববাদের ঘেরাটোপ থেকে বৃহত্তর জগতে প্রবেশ করলেন। এর মধ্য দিয়ে সেই বিতর্কেরও প্রতীকী অবসান হলো, অর্থাৎ ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে শেষবিচারে ভেদাভেদ নেই। নদীতে সেই বালকের ঝাঁপ দেওয়ার দৃশ্য যেন রঞ্জনের নতুন জীবনে প্রবেশ করার প্রতীক, নদীতে অবগাহন করে নতুন জীবনের সন্ধান লাভ। এর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকার হিসেবেও মুনশিয়ানার পরিচয় দেন অঞ্জন দত্ত—চলচ্চিত্র তো দৃশ্যকাব্য।
পরবর্তীকালে কলকাতা শহর নিয়ে যেসব অমর গান রচনা করেছেন অঞ্জন দত্ত, এর পেছনে মৃণাল সেনের ভূমিকা আছে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
প্রতীক বর্ধন প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক