সিরিয়ার নতুন শাসক শারা কেন ইসরায়েলের আগ্রাসনে নীরব

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সিরিয়ার নতুন শাসক দল এইচটিএসের নেতা আল–জুলানি

ভূগোলগত নৈকট্য এবং অভিন্ন ইতিহাসের কারণে সিরিয়া সব সময়ই ফিলিস্তিন মুক্তির সংগ্রামের কেন্দ্রস্থলে ছিল। তবে একেক সময় এ বিষয়ে সিরিয়ার ভূমিকা ছিল একেক রকম। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধ এবং মিসর একতরফাভাবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর থেকে সিরিয়া সরাসরি সামরিকভাবে অংশগ্রহণ বন্ধ করে দেয়। তবে লেবাননের গৃহযুদ্ধের সময় সিরিয়া কিছু বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে জড়িয়েছিল।

১৯৯১ সালে মাদ্রিদ সম্মেলন ভেস্তে গেল। এরপর থেকে সিরিয়ার পরোক্ষ প্রতিরোধ ভূমিকা আবার গুরুত্ব পায়। এর পরপরই ইসরায়েল দ্রুত ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) সঙ্গে অসলো চুক্তি এবং জর্ডানের সঙ্গে ওয়াদি আরাবা চুক্তি স্বাক্ষর করে। লেবাননের পর সিরিয়াই একমাত্র আরব রাষ্ট্র, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে হাঁটেনি।

আরও পড়ুন

গোলান মালভূমিতে দখলদারদের প্রতিরোধ দমন করেছে সিরিয়া। তবে আসাদ শাসনের অধীনে সিরিয়া ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহ নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক ছিল।

সিরিয়া তাদের সরঞ্জাম দিয়ে লজিস্টিক সহায়তা এবং ভূরাজনৈতিক সহায়তা দিয়েছে। ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবাননের মুক্তি এবং ২০০৬ সালের যুদ্ধ সিরিয়ার এই অবস্থানের যৌক্তিকতা আরও দৃঢ় করে। তবে সব মিলিয়ে সিরিয়ার সঙ্গে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের সম্পর্ক কখনোই এক রকম ছিল না। কিন্তু ২০২২ সালে হামাসের সঙ্গে কূটনৈতিক পুনর্মিলনের মধ্য দিয়ে সিরিয়া ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ নামে পরিচিত জোটের মধ্যে আসে।

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ইসরায়েলের লেবানন আক্রমণের পর থেকে ইরান এবং সিরিয়ার হিজবুল্লাহ ও হামাসকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। আসাদের পতনের পর পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে যায়। সিরিয়ার ভেতরে তো সবই বদলে গেছে। এর ফলে ইসরায়েল এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী প্রতিরোধে সিরিয়ার ভূমিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

ইসরায়েলের গোলান দখলকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুমোদন দিয়েছেন। আসাদ ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতকে ব্যবহার করেছে নিজের দমনমূলক শাসনকে ন্যায়সংগত করতে। সিরিয়ার নতুন সরকারের এ অবস্থান বদলানোর সুযোগ আছে। নতুন সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা যা–ই হোক না কেন, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে ঐক্যই এই অঞ্চলের মুক্তির চাবিকাঠি।

প্রাথমিকভাবে যা বোঝা যাচ্ছে, তা স্বস্তিদায়ক নয়। দামেস্কে প্রবেশের আগে হায়াত তাহরির আল–শামের (এইচটিএস) নেতা আহমেদ আল-শারায়া (আল-জুলানি নামে পরিচিত) এই অঞ্চলে ইরানি হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় মনোযোগ দেয়। আবার মার্কিন ঘাঁটিগুলোর বিষয়ে সহনশীলতা প্রকাশ করে। এড়িয়ে যায় ইসরায়েলের বিষয়টি।

আসাদের পতনের পরও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ইসরায়েলের বিমান হামলায় সিরিয়ার উল্লেখযোগ্য সামরিক সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। তেল আবিব আসাদ পতনের পর দ্রুত স্থল আক্রমণ করে সার্বভৌমত্বের প্রকাশ্য লঙ্ঘন করে সিরিয়ার আরও ভূমি দখল করে। ইসরায়েলি ট্যাংক দামেস্ক থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরত্বে পৌঁছায়।

এসব নিয়ে জুলানির প্রতিক্রিয়া ছিল নীরব। ইসরায়েল ১৯৭৪ সালের চুক্তি বাতিল করলেও জুলানি সেই চুক্তির প্রতি অটল থেকে জানান যে তাঁর বাহিনী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায় না। তিনি গৎবাঁধা আরব শাসকদের মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি তেল আবিবের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান।

আরও পড়ুন

আরও একটা উদ্বেগের বিষয় আছে। আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরই সিরিয়ার ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির বন্ধ হয়ে যায়। হিজবুল্লাহর নতুন মহাসচিব নাইম কাসিমের নিশ্চিত করেন যে সিরিয়ার সরবরাহ লাইন বন্ধ হয়ে গেছে। এসবই ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের জন্য দীর্ঘমেয়াদি খারাপ ইঙ্গিত। কারণ, ইসরায়েলি আগ্রাসন ও দখলদারির বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গড়ে তোলা এ অঞ্চলের জনগণের স্বার্থেই প্রয়োজন।

যদি সিরিয়ার নতুন শাসক ইসরায়েলি দখলদারত্ব এবং ফিলিস্তিন মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হয়, তাহলে সদিচ্ছা দেখানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আসাদ শাসন এখন আর নেই। এ অঞ্চলে ইরানের প্রভাব কমেছে। গাজার বিষয়ে হিজবুল্লাহর নীতিগত অবস্থান আরব অঞ্চলে তাদের জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে দিয়েছে।

ইসরায়েল এখন একাধিক ফ্রন্টে সম্প্রসারণবাদী যুদ্ধ চালাচ্ছে। এই যুদ্ধে তারা ফিলিস্তিনি, লেবাননি বা সিরীয় স্বার্থের মধ্যে কোনো পার্থক্য করছে না। সিরিয়া যদি আন্তরিক হয় তাহলে লেবানন এবং ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে জোট রক্ষা করার কথা। হিজবুল্লাহর সঙ্গে এই জোট পুনর্গঠন করতে হলে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। নয়তো হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সিরিয়ার প্রতিশোধ নিতে পারে। যেহেতু হিজবুল্লাহ ছিল আসাদের মিত্র। সরবরাহ লাইন চিরতরে কেটে দিতে পারে। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্রাজ্যবাদী স্বপ্ন। কিন্তু ‘নিরপেক্ষ’ সিরিয়া, তুরস্ক বা উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে জোটবদ্ধ হলেও গোলান মালভূমি ফেরত পাবে না।

ইসরায়েলের গোলান দখলকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনুমোদন দিয়েছেন। আসাদ ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতকে ব্যবহার করেছে নিজের দমনমূলক শাসনকে ন্যায়সংগত করতে। সিরিয়ার নতুন সরকারের এ অবস্থান বদলানোর সুযোগ আছে।

নতুন সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা যা–ই হোক না কেন, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে ঐক্যই এই অঞ্চলের মুক্তির চাবিকাঠি।

  • হিশাম সাফিয়েদ্দিন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার ইতিহাসের অধ্যাপক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত