চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ‘গ্রেট গেমের’ নতুন মঞ্চ মধ্য এশিয়া

‘কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান নিয়ে গঠিত মধ্য এশিয়া নিজেকে তাই একটি জটিল সন্ধিক্ষণের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে।’

পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ শতকেই শেষ হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করতেন। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে ধ্বংসাবশেষ থেকে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার পুনর্জন্ম হয়েছে।

এ সংঘাতের তাৎক্ষণিক উত্তাপ একটা পর্যায়ে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়া পরাশক্তির প্রতিযোগিতার অন্যতম মঞ্চ হয়ে উঠেছে।

পর্যবেক্ষকেরা দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বের কথা বলে আসছিলেন। ইউক্রেন যুদ্ধপরবর্তী স্বাভাবিকীকরণের যে কালপর্বের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে মধ্য এশিয়া এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যেখানে রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তাদের স্বার্থ নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে।

পরাশক্তির এ দ্বন্দ্বে মধ্য এশিয়া ভূরাজনৈতিক অন্য সব প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র থেকে আলাদা। কারণ, বর্তমান বিশ্বে তিনটির মধ্যে দুটি পরাশক্তির (চীন ও রাশিয়ার) এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে বিশাল একটি সীমানা রয়েছে। ফলে এখানে ঝুঁকিটা অনেক বেশি।

কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান নিয়ে গঠিত মধ্য এশিয়া নিজেকে তাই একটি জটিল সন্ধিক্ষণের মধ্যে দেখতে পাচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবেও মধ্য এশিয়া সাম্রাজ্যগুলোর সন্ধিস্থল। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুক্ত হওয়ার পর প্রতিবেশী বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।

যাহোক, সামষ্টিক নিরাপত্তার জন্য একটা জোরালো ও স্থানীয় ব্যবস্থাপনা না থাকায় অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা নিয়ে একটা ভঙ্গুরতা দেখা দিয়েছে। এখানকার খণ্ডবিখণ্ডিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি যে ভূরাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে, সেটা পূরণ করতে প্রধান পরাশক্তিগুলোর আগ্রহ বেড়েই চলেছে।

মধ্য এশিয়ায় একটি একীভূত আঞ্চলিক পরিচয় না থাকার যে ঘাটতি, সেটাকে প্রাথমিকভাবে দুর্বলতা বলে মনে হয়। কিন্তু এটা আবার পরাশক্তিগুলোর চলমান প্রতিযোগিতায় চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ—দুটিই নিয়ে এসেছে।

পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। রাশিয়ার জন্য মধ্য এশিয়া এখনো তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাববলয়ের কেন্দ্র হয়ে রয়েছে। পশ্চিমাদের দিক থেকে আসা হুমকির বিরুদ্ধে মধ্য এশিয়া রাশিয়ার একটা বাফার অঞ্চল। এটি মস্কোর গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট রুট।

ওয়াশিংটন, বেইজিং ও মস্কোর নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই মধ্য এশিয়ার এই গতিশীলতাকে বুঝতে হবে। গঠনমূলক উপায়ে সেখানে সম্পৃক্ত হওয়ার পথ খুঁজতে হবে। সেটা শুধু মধ্য এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বৃহত্তর ইউরেশিয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

ইউক্রেন যুদ্ধ মস্কোর সম্পদের ওপর যখন চাপ তৈরি করছে, তখন এই ‘কাছের বিদেশ’ দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিকল্প বাণিজ্যপথ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) মাধ্যমে মধ্য এশিয়াকে তার মহাদেশীয় সংযোগের অপরিহার্য উপাদান বলে মনে করে। চীনের পশ্চিমা অভিমুখী সম্প্রসারণের যে নীতি, সেখানে মধ্য এশিয়া যেমন সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎস, আবার কৌশলগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।

মধ্য এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবেই ওঠানামা করেছে। সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মকাণ্ড, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে উৎসাহ দেওয়া এবং চীন ও রাশিয়ার প্রভাব কমানো—এ তিন সূত্রে অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নির্ভর করে।
মধ্য এশিয়ায় তিন পরাশক্তির স্বার্থ অভিন্ন নয়। এই স্বার্থের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য।

ইউক্রেন যুদ্ধ, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক স্বার্থ ও রাজনৈতিক প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাশিয়ার অবস্থান দুর্বল হয়েছে।

যদিও বর্তমানে রাশিয়া ও চীনের সরকারি পর্যায়ে যে আলাপ-আলোচনা, সেখানে অংশীদারত্বের কথাই জোরেশোরে বলা হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে অঞ্চলটিতে চীনের উত্থান মস্কোর অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, চীন ও রাশিয়া অঞ্চলটিতে তাদের কর্তৃত্ববাদী মডেলের বিস্তার ঘটাচ্ছে এবং মধ্য এশিয়ায় গণতান্ত্রিক পরিসর সংকুচিত হয়ে আসছে।

অবকাঠামো প্রকল্প, নিরাপত্তা সহযাগিতা এবং এমনকি সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো পরাশক্তিগুলোর কর্তৃত্ব প্রদর্শনের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক রূপরেখা প্রয়োজন। সেটির অভাবে মধ্য এশিয়া পরাশক্তিগুলোর ‘গ্রেট গেমের’ মঞ্চ হয়ে ওঠার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। ‘সিফাইভ প্লাস ওয়ান’ সে রকমই একটি প্ল্যাটফর্ম। এটা মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি কূটনৈতিক প্ল্যাটফর্ম।

এখানে নমনীয় একটি নীতির মাধ্যমে প্রতিটি দেশকেই তার প্রয়োজনীয়তা ও স্বার্থ অনুযায়ী বিদেশি শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।

মধ্য এশিয়া পরাশক্তির প্রতিযোগিতার নিছক একটি মঞ্চে পরিণত হবে, নাকি ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এ অঞ্চলের যে কৌশলগত গুরুত্ব, সেটাকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যাবে, সেটা নির্ভর করবে ‘সিফাইভ প্লাস ওয়ান’-এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর সফলতার ওপর।

ওয়াশিংটন, বেইজিং ও মস্কোর নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই মধ্য এশিয়ার এই গতিশীলতাকে বুঝতে হবে। গঠনমূলক উপায়ে সেখানে সম্পৃক্ত হওয়ার পথ খুঁজতে হবে। সেটা শুধু মধ্য এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বৃহত্তর ইউরেশিয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

  • মিরাস ঝায়েনবায়েভ, কাজাখস্তানের আস্তানায় মাকসুত নারিকবায়েভ ইনস্টিটিউট ফর নেটওয়ার্কিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফরেন পলিসি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ প্রোগ্রামের প্রধান

    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত