‘রাজনৈতিক দলগুলো না চাইলে সংস্কার হবে না, তারা চাইলে নির্বাচন দিয়ে দেব’—অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই বক্তব্যে হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। যাঁরা ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে নেওয়া সাক্ষাৎকারটি শুনেছেন, তাঁরা অনেকেই হতাশ হয়েছেন বোধ হয়। এর পরের বাক্যটি ছিল আরও হতাশাজনক। তিনি বলেছেন, ‘জনগণ পর্যন্ত যেতে পারব না, রাজনৈতিক দল পর্যন্তই। জনগণের কাছে যেতে হলে আবার একটা রেফারেন্ডাম...।’
বাক্যটি তিনি শেষ করেননি। তবে তাঁর অভিব্যক্তি বলছিল, তিনি বেশ বিরক্ত, হতাশ ও ক্লান্ত। অথচ দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিন থেকে বেশ অনেক দিন পর্যন্ত তাঁকে রাষ্ট্রসংস্কারের প্রশ্নে আপসহীন মনে হয়েছিল।
প্রথম দিকে মনে হয়েছিল এই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ড. ইউনূস একাত্ম। আমাদের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মতো তিনি নষ্ট স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মানুষ নন। তারুণ্যের প্রত্যাশা তিনি সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছেন। আমরা এখনো বিশ্বাস করি, সেই বোধ ও বিশ্বাসের মধ্যেই তিনি আছেন। হয়তো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ঠিক এই সময়ে আমাদের উচিত হবে তাঁর পাশে থাকা। তাঁর হাতকে শক্তিশালী করা আর তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের সিদ্ধান্তের, কাজের ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেওয়া।
সৃজনতাড়না যাঁদের থাকে, তাঁরা কিছুটা তাড়ায় থাকেন। একে সৃজনশীল মানুষের বৈশিষ্ট্য হিসেবে মেনে নিতে হয়। ড. ইউনূসের মধ্যে এমন কিছু প্রবণতা আছে। আগে একবার ‘নাগরিক শক্তি’ নাম দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করলেন। তিন মাসের মধ্যেই ঘোষণা দিয়ে বিলোপ সাধন করলেন। তখন তাঁর চিন্তা, দল গঠন এবং বিলোপ সাধন—পুরো প্রক্রিয়াতেই তাড়াহুড়া দোষে দুষ্ট মনে হয়েছে। কিন্তু তাঁর যোগ্যতা, দূরদর্শিতা, সাংগঠনিক দক্ষতা আর ব্যক্তি হিসেবে সততা নিয়ে সন্দেহের কখনো কারণ ঘটেনি। এখন তিনি এই দেশের হাল ধরেছেন।
কিন্তু আজ তিনি যখন বলেন, ‘জনগণ পর্যন্ত যেতে পারব না, তাহলে আবার একটা রেফারেন্ডাম...’ তখন যেন ক্লান্তি দেখা যায়। আর শোনা যায় উদ্যমে ভাটা পড়ার আওয়াজ। কিন্তু আজ তো ড. ইউনূস আর তাঁর অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের স্বপ্নের নির্যাস। এই স্বপ্ন রচিত হয়েছে হাজার হাজার শহীদের রক্ত, আহত বিপ্লবী ও তাঁদের পরিবারের দীর্ঘশ্বাস দিয়ে। ‘জনগণের কাছে যেতে পারব না’ বাক্যটি সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অন্যায় বলে মনে হয়।
সরকার তো ঠিক রাস্তায়ই হাঁটছিল। হঠাৎ রাজনৈতিক খানাখন্দে পড়ে হোঁচট খেলে তো চলবে না। যে লক্ষ্য ঠিক করেছেন, সেই লক্ষ্য থেকে একচুল এদিক-সেদিক হওয়ার কি এই সরকারের কোনো সুযোগ আছে? সংস্কারের লক্ষ্যই কি এই সরকারের একমাত্র বৈধতা ও ম্যান্ডেট নয়? এখান থেকে বিচ্যুত হওয়া মানেই কি বৈধতার ভিত নড়ে যাওয়া নয়?
আমাদের উচিত হবে এই কথা মনে করিয়ে দেওয়া যে এই অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পথ কোনো রাজনৈতিক দল নির্মাণ করে দেয়নি। এই পথ নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, এ দেশের সাধারণ ছাত্র-জনতা। তাঁরা সবাই জুলাই মাসে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য রাজপথে নিজের জীবন দিতে নেমে এসেছিলেন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশি হিসেবে। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের হয়ে নয়। কাজেই আজ সংস্কারের প্রশ্নে যদি কারও সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয়, তা করতে হবে সেই সব মানুষের সঙ্গে।
প্রকৃতপক্ষে ‘আবার একটা রেফারেন্ডাম’–এর কোনো প্রয়োজনও তো নেই। রেফারেন্ডামের মধ্য দিয়ে কি আমরা এই সরকার গঠন করেছি? যে জনস্রোত সরকার গঠন করেছে, তারাই তো একই সঙ্গে ঠিক করে দিয়েছে কী হবে এই সরকারের দায়িত্ব এবং সেই দায়িত্ব এই সরকার ঠিকঠাক বুঝেই ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।
সরকার তো ঠিক রাস্তায়ই হাঁটছিল। হঠাৎ রাজনৈতিক খানাখন্দে পড়ে হোঁচট খেলে তো চলবে না। যে লক্ষ্য ঠিক করেছেন, সেই লক্ষ্য থেকে একচুল এদিক-সেদিক হওয়ার কি এই সরকারের কোনো সুযোগ আছে? সংস্কারের লক্ষ্যই কি এই সরকারের একমাত্র বৈধতা ও ম্যান্ডেট নয়? এখান থেকে বিচ্যুত হওয়া মানেই কি বৈধতার ভিত নড়ে যাওয়া নয়?
বরং ড. ইউনূস যেটা বলেছেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার না চাইলে হবে না, নির্বাচন দিয়ে দেব’—এই পথে পা বাড়ানোর কোনো ম্যান্ডেট বা বৈধতা এই সরকারের নেই। যদি এটা করতে চান, তাহলেই বরং সরকারকে জনগণের কাছে যেতে হবে, রেফারেন্ডামের আয়োজন করতে হবে। কারণ, জনগণ আপনাদের এই ম্যান্ডেট দেয়নি, এই কাজের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেনি।
তাহলে কি সরকার নির্বাচন করবে না? হ্যাঁ অবশ্যই করবে, সেটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আসবে, নির্বাচন না হলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে কী করে? নির্বাচন তো হতেই হবে। তবে নতুন বাংলাদেশের মানুষের জন্য কেমন নির্বাচন হবে, কেমন সংবিধানের আলোকে হবে, এগুলো ঠিক না করে আপনি কোন নির্বাচন করবেন? আবার একটা ফ্যাসিস্ট সরকার তৈরি করার নির্বাচন? তা হতেই পারে না।
এ দেশে অতীতেও এমন অনেক অরাজনৈতিক সরকার গঠিত হয়েছিল। তাদের কথা শ্রদ্ধাভরে কেউ উচ্চারণ করে না। যদি এই সরকার সত্যিকার অর্থে জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি নির্মাণ করে দিয়ে যেতে না পারে, যা কেবল রাষ্ট্রসংস্কারের মধ্য দিয়েই অর্জন করা সম্ভব, তাহলে আপনারাও বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্ধকারে তলিয়ে যাবেন।
যদি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবার একটি ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে জুলাই বিপ্লবে নিহত, গণতন্ত্রের জন্য, সুশাসনের জন্য গত ৫৩ বছরে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সব শহীদের প্রতি অন্যায় করা হবে। এ দেশের খেটে-খাওয়া মানুষ আর কোনো দিন কাউকে বিশ্বাস করবে না। মানুষের হৃদয়ে শাসক সম্পর্কে একটি স্থায়ী অবিশ্বাস তৈরি হবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস নিজেও একাধিকবার বলেছেন, ‘আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ বাক্যটির সঙ্গে আরও একটি বাক্য এখন যোগ করে দিতে হবে, ‘আমাদের ভুল করারও কোনো সুযোগ নেই।’
কাজী জহিরুল ইসলাম কবি, প্রাবন্ধিক