শরীফ বনাম শরীফা: মতপ্রকাশ, নাকি অপব্যাখ্যার স্বাধীনতা

সম্প্রতি আসিফ মাহতাব নামে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক খণ্ডকালীন শিক্ষকের বই ছেঁড়ার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়।

তিনি জাতীয় শিক্ষক সম্মেলনে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের দুটি পাতা ছেঁড়েন, যেখানে বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এ কারণে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বরখাস্ত করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় মাহতাবের পক্ষে এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা এখন আর ফেসবুকে সীমাবদ্ধ নেই। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পৌঁছে গেছে।

মাহতাবের সমর্থনে যে আন্দোলন হচ্ছে, তা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মর্যাদা ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তবে কেবল তার পক্ষে নয়, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকারের পক্ষেও মানুষ কথা বলছেন। কেউ কেউ বলছেন, মাহতাবের এই অতি উৎসাহী বক্তব্য ও বই ছেঁড়া কর্মকাণ্ড প্রচারিত না হলে জনগণ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকারের ব্যাপারে জানতে পারতেন না। সেদিক থেকে এটি ইতিবাচক।

দেশের মানুষ আজ দৃশ্যত দুই ভাগে বিভক্ত। এদিক বিবেচনা করেই সদ্য নিয়োজিত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, যেহেতু হিজড়ারা আইনগতভাবে স্বীকৃত এবং বাংলাদেশের নাগরিক, সেহেতু তাঁদের নাগরিক অধিকার রয়েছে।

তিনি এ-ও বলেন, ‘তবে গল্প উপস্থাপনার ক্ষেত্রে যদি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেখানে এ ধরনের বিভ্রান্তি ও বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস থাকে, তাহলে এ গল্পের উপস্থাপন পরিবর্তন করা যায় কি না, তা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করব।’

হিজড়াদের প্রতি সম্মান রেখে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে উপস্থাপনের ধরনে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন হলে সেটি করা হবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

প্রত্যেক ব্যক্তির বিশ্বাসের অধিকার রয়েছে। তবে যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে এই অধিকার চর্চিত হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে এ রকমটি হয়ে থাকে।

কিন্তু আসিফ মাহতাব যখন তাঁর বিশ্বাসকে জোরপূর্বক অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান, তখন তিনি অধিকারের সীমা অতিক্রম করে যুক্তিসংগত বাধানিষেধের সীমায় প্রবেশ করেন। কারণ, তাঁর উদ্দীপনাময় ভাষণ ভাইরাল হওয়ার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠী বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে।

২০২৩ সালে সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইটিতে ট্রান্সজেন্ডার কথাটি ব্যবহার করা হয়। এবার সেই শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ধারণাটি থেকে গেছে বলে মনে হয়। এ বছরের বইটিতে লেখা রয়েছে, ‘আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে।’ অনেকে এই ‘মনে মনে’ ব্যাপারটি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। মূল সমস্যা হয়ে গেছে শব্দচয়ন ও তার ব্যাখ্যায়।

একজন মানুষ হিসেবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে ন্যূনতম সহমর্মিতা তো দূরে থাক, একজন ‘একাডেমিশিয়ান’ হিসেবে তার বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

একজন গবেষকের উচিত কোনো বিষয়ের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করা। একজন উগ্র নেতার মতো বক্তৃতা করে ভাইরাল হওয়া তাঁর জন্য সমীচীন নয়।

আসিফ মাহতাবের বক্তব্যে কতগুলো অসংগতি ধরা পড়ে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আসিফ যৌনতা ও জেন্ডার ধারণার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যগুলো ধরতে পারেননি। একটিকে আরেকটির প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সপ্তম শ্রেণির এই বইয়ে কোনোভাবেই সমকামিতাকে প্রচার করার চেষ্টা করা হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ঘোষণা করেছিলাম, ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মূল চালিকা শক্তি। মানবিক মর্যাদা মানবাধিকারের মূল ভিত্তি। ইসলামের নাম ব্যবহার করে সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বই ও সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করা হচ্ছে। অথচ ইসলাম মানুষের মর্যাদাকে কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইসলাম বলে, মানুষ নিষ্পাপ হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। মার্কিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা সব মানুষকে সমান করে সৃষ্টি করেছেন। এই কথা কি ইসলামেরও মূল কথা নয়?

হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টি মনে করলে তাঁদের ‘অস্বাভাবিক’ ও ভীতিপ্রদ মনে হতো না। তাঁদের প্রতি সমাজের অধিকাংশ মানুষের মনোভাব তাঁদের সমাজে প্রান্তিক করে তুলেছে। সে জন্য তাঁরা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারেন না। তাঁদের ‘গুরুমা’র কাছে আশ্রয় নিতে হয়। তাঁরা শখ করে পরিবার ছেড়ে গুরুমার কাছে যান না।

হিজড়াদের প্রতি সাধারণ মানুষের ভয়কে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ নানাভাবে অর্থ করছেন। তাঁদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব সহজ ও স্বাভাবিক হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে না বলেই আমার বিশ্বাস।

এখন পাঠ্যবই সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। ২০২৩ সালে সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইটিতে ট্রান্সজেন্ডার কথাটি ব্যবহার করা হয়। এবার সেই শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে ধারণাটি থেকে গেছে বলে মনে হয়।

এ বছরের বইটিতে লেখা রয়েছে, ‘আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে।’ অনেকে এই ‘মনে মনে’ ব্যাপারটি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। মূল সমস্যা হয়ে গেছে শব্দচয়ন ও তার ব্যাখ্যায়।

বাংলাদেশে আমরা যাঁদের হিজড়া নামে চিনি, তাঁরা কেউ ‘মনে মনে’ হিজড়া নন। তাঁরা শারীরিকভাবেই হিজড়া। তবে ইংরেজিতে ব্যবহৃত ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়, যেখানে শারীরিকভাবে ও ‘মনে মনে’ যাঁরা নারী বা পুরুষ, তাঁরাও অন্তর্ভুক্ত।

একজন মানুষের জেন্ডার কী হবে, তা ওই ব্যক্তি নির্ধারণ করবেন—এটাই ট্রান্সজেন্ডার শব্দের পেছনে মূল ভাব। একে সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। এই দুটি বিষয় একেবারেই ভিন্ন।

পাঠ্যপুস্তকের লেখকেরা আরেকটু সতর্ক ও যত্নবান হলে এ রকম ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ থাকত না। তবে মানবিক মর্যাদা ও অধিকার কেবল হিজড়া জনগোষ্ঠী পাবে, এমন নয়। ট্রান্সজেন্ডারভুক্ত অন্যদেরও পাওয়া উচিত। মানুষমাত্রেরই মর্যাদা, সমতা, নিরাপত্তা ও অন্যান্য অধিকার পাওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে সবার সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়নি।

আরও পড়ুন

প্রসঙ্গক্রমে এ কথা বলতেই হবে, ‘মনে মনে’ শব্দদ্বয় ব্যবহারের মাধ্যমে কোনোভাবেই সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হয়নি। পুরো প্রবন্ধ পাঠ করলে কোথাও সে ধরনের কোনো ইঙ্গিত চোখে পড়ে না। অথচ এনসিটিবির একটি মহতী উদ্যোগে কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। এরপরও শিক্ষামন্ত্রী বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পাঠ্যবইয়ের এই বিশেষ অংশটি যাচাই করে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। আশা করি, এবার পাঠ্যবইয়ের ভুল-বোঝাবুঝি দূর হবে।

অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন