উত্তর ইরানের পাহাড়ি এলাকায় কপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে রোববার প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের মৃত্যু ইরান ও এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎকে কিছুটা হলেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে ভ্রমণ করার সময় প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ানও নিহত হন।
ঘন কুয়াশার কারণে দুর্ঘটনাস্থল খুঁজে পেতে কয়েক ঘণ্টা লেগে গেছে। কুয়াশা এতটাই ঘন ছিল যে হেলিকপ্টারটি শনাক্ত করতে সহায়তা করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্যাটেলাইটগুলোর সহায়তা চাইতে ইরানিদের বাধ্য হতে হয়েছে।
ইরান যখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কঠোর পন্থা বেছে নিয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যকে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের কিনারে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, ঠিক এমন এক সময় এই দুর্ঘটনাকে ইরানের রাজনীতিতে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু রূপান্তরমূলক যুগের উপসংহার বলা যেতে পারে।
প্রায় তিন বছরের ক্ষমতাকালে ইব্রাহিম রাইসি ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সামাজিক নীতিকে আগের চেয়ে অনেক বেশি রক্ষণশীল জায়গায় নিয়ে যান। পূর্বসূরি হাসান রুহানির পর তিনি এই অঞ্চলে ইরানকে স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষের ভূমিকায় ঠেলে দেন।
ইরানের একজন শুরা সদস্য কিছুদিন আগে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গে রাইসির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছিলেন এবং দেশটির অনেক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞের ধারণা ছিল, খামেনির উত্তরাধিকারী হওয়ার দৌড়ে রাইসি প্রথম সারিতে থাকবেন।
২০১৮ সালে তৎকালীন ট্রাম্প সরকার ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তিন বছর পর গদিতে বসে রাইসি ক্রমাগত ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে গতি বাড়িয়েছিলেন এবং ইরান চুক্তি নিয়ে পশ্চিমের সঙ্গে আলোচনার গতি কমিয়ে দিয়েছিলেন। রাইসির অধীনস্থ ইরান সরকার ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে এবং রাশিয়াকে শাহেদ নামের আত্মঘাতী ড্রোন এবং প্রচুর গোলাবারুদ দিয়েছে।
এখন রাইসির মৃত্যুজনিত আগাম নির্বাচনকে ঘিরে শাসক শ্রেণির শীর্ষে দলাদলি ও রেষারেষির আশঙ্কা আছে। ৮৫ বছর বয়সী খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে রাইসির নাম উঠে আসছিল। কিন্তু এখন তাঁর মৃত্যুর কারণে খামেনির উত্তরসূরি নির্ধারণ প্রশ্নে ইরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে রাইসির ইরান যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিভিন্ন কৌশলগত স্বার্থে আঞ্চলিক প্রক্সি যোদ্ধাদের দিয়ে হামলা চালিয়েছে। তাঁর এই অকস্মাৎ মৃত্যুর মাত্র এক মাস আগে ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশ্চিমদের সম্পর্কে ইরানের গ্রহণ করা নীতি এবং কৌশল সম্পর্কে রাইসি তাঁর দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে যে শক্ত সংহতি স্থাপন করে গেছেন তাতে মনে হচ্ছে, তাঁর জায়গা কে প্রেসিডেন্ট হবেন, সেটি কোনো বড় বিষয় হিসেবে থাকছে না। কারণ প্রেসিডেন্টের গদিতে এখন যে-ই বসুন না কেন, ইরানে রাইসির অনুসৃত নীতির কোনো বদল হবে না।
ইরানের গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখেন ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিস (এফডিডি)-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো বেহনাম বেন তালেবলু। তাঁর ভাষ্য হলো, ৭ অক্টোবরের পর মধ্যপ্রাচ্য যেভাবে বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিয়েছে তা রাইসিসহ কিংবা রাইসিবিহিন—উভয় ইরানের জন্যই সন্তোষজনক হবে।
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী আগামী ৫০ দিন প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবে থাকবেন এবং এর মধ্যে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আয়োজন করবেন।
বিশ্লেষকেরা বলেছেন, সাম্প্রতিক পার্লামেন্টারি নির্বাচনে রেকর্ড মাত্রার কম ভোট পড়েছে। তার চেয়ে বড় কথা, ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনের সময় রাইসির জয় নিশ্চিত করার জন্য খামেনি ও তাঁর সহযোগীরা সব ধরনের ক্ষমতা খাটিয়েছিলেন এবং অন্য সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে রাইসি ইরানের প্রসিকিউশন কমিটিতে কাজ করেছিলেন। এই কমিটির মাধ্যমেই ১৯৮৮ সালে ইরান সরকার প্রায় ৫ হাজার ভিন্নমতাবলম্বীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল। রাইসিকে জাতিসংঘ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তাঁর চালু করা কঠোর নীতির শিকার হয়েছিলেন ২২ বছর বয়সী মাহশা আমিনি।
এখন রাইসির মৃত্যুজনিত আগাম নির্বাচনকে ঘিরে শাসক শ্রেণির শীর্ষে দলাদলি ও রেষারেষির আশঙ্কা আছে। ৮৫ বছর বয়সী খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে রাইসির নাম উঠে আসছিল। কিন্তু এখন তাঁর মৃত্যুর কারণে খামেনির উত্তরসূরি নির্ধারণ প্রশ্নে ইরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অস্থিরতার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর বৃহত্তম শাখা ও দেশটির অর্থনীতির বড় অংশকে নিয়ন্ত্রণ করা ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) রাজনীতিতে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে।
ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটির নিয়ার ইস্ট সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক এবং অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন সেনা কর্নেল ডেভিড ডেস রোচেস বলেন, খামেনি চলে গেলে তাঁর কোনো উত্তরাধিকারী নেই। এ অবস্থায় আইআরজিসি একটি ধীর গতির অভ্যুত্থান ঘটাবে কিনা সেটিই দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লক্ষ্য করার বিষয় হলো, উদ্ধারকর্মীরা যখন রাইসির বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারটির সন্ধান করছিলেন, তখন রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ইরানের জনগণকে তাঁর জন্য দোয়া করতে বলা হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে কিছু ইরানিকে কট্টরপন্থী রাইসির সম্ভাব্য মৃত্যুতে উল্লাস প্রকাশ করে আতশবাজি ফাটাতে দেখা গেছে।
নেভাল পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ইরান বিশেষজ্ঞ আফশোন অস্তোভার রাইসির মৃত্যুর নিশ্চিত খবর প্রকাশিত হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, ‘আজকের দুর্ঘটনা এবং প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্ভাব্য মৃত্যু ইরানের রাজনীতিকে নাড়িয়ে দেবে। কারণ যাই হোক না কেন, প্রশাসনের মধ্যে যে এখন একটি ফাউল খেলার ধারণা ছড়িয়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। উচ্চাভিলাষী গোষ্ঠীগুলো সুবিধা আদায়ের জন্য সুযোগ খুঁজতে পারে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগাম নির্বাচনে ইরানে উদারনৈতিক কোনো ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হওয়ার সম্ভাবনা কম; তবে রাইসির মৃত্যু প্রতিবাদ আন্দোলনকে আবার চাগিয়ে তুলতে পারে।
জ্যাক ডেটশ ফরেন পলিসির পেন্টাগন এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদক
ফরেন পলিসি থেকে নেওয়া। অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ