আজ ছুটির দিন। এমনিতেই দুঃসংবাদে দুঃসংবাদে আমাদের দিনরাত্রিগুলো আতঙ্কময় হয়ে আছে। এ অবস্থা থেকে আমাদেরও তো একটুখানি ছুটি চাই। একটুখানি হাসি, একটুখানি রসিকতা না থাকলে আমরা বাঁচব কী করে?
কাজেই কতগুলো কৌতুক বলতে থাকি।
একজন বেলুনে করে উড়ছেন। উড়তে উড়তে একসময় তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি আসলে হারিয়ে গেছেন। মানে বুঝতে পারছেন না, তিনি এখন কোথায়। তিনি বেলুনটাকে নিচের দিকে নামাতে থাকলেন। নিচে একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। বেলুন থেকে লোকটা চিৎকার করে বললেন, ভাই, আমি এখন কোথায়?
নিচের লোকটা উত্তর দিল, আপনি মাটি থেকে ঠিক ৩০ ফুট ওপরে।
ওপরের লোকটা বললেন, আপনি নিশ্চয়ই ইঞ্জিনিয়ার।
‘হ্যাঁ। আমি ইঞ্জিনিয়ার। কী করে বুঝলেন?’
‘আপনি যা বললেন, তার সবই সঠিক। কিন্তু তা আমার কোনো কাজে লাগবে না। ইঞ্জিনিয়াররা এ রকমই বলে থাকে।’
‘আপনি নিশ্চয়ই ম্যানেজমেন্টের লোক।’
‘হ্যাঁ। কী করে বুঝলেন?’
‘আপনি জানেন না, আপনি কোথায় ছিলেন। আপনি জানেন না আপনি কোথায় আছেন। আপনি জানেন না আপনি কোথায় যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেও আপনি তা-ই ছিলেন। এখন আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আপনি ভাবছেন আপনার এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী।’
কারও কথা শুনেই বলে দেওয়া যায়, তার পেশাটা কী!
কারও-বা কাজ দেখে বলা যায়, তিনি কে?
যেমন আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো আর ডোনাল্ড ট্রাম্প গেছেন স্বর্গের দরজায়। প্রহরী প্রথমে আটকাল আইনস্টাইনকে। আপনি কেন স্বর্গে ঢুকবেন?
কারণ, আমি আইনস্টাইন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী।
জি জি আপনার নাম শুনেছি। কিন্তু আপনিই যে আইনস্টাইন, তার প্রমাণ কী? এই কাগজে কি একটু লিখে দেবেন!
আইনস্টাইন লিখলেন ই=এমসি স্কয়ার। তারপর সাইন করে দিলেন।
প্রহরী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বলল, মহামান্য আইনস্টাইন, আপনি ভেতরে যেতে পারেন।
এরপর এলেন পাবলো পিকাসো। প্রহরী প্রমাণ চাইল। পিকাসো এক টানে তাঁর বিখ্যাত পায়রার ছবিটা এঁকে দিয়ে সাইন করে দিলেন।
প্রহরী বলল, মহামান্য পিকাসো, আপনাকে স্বর্গে স্বাগত।
এরপর এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রহরী বলল, আপনি কেন স্বর্গে যাবেন।
আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আমি অবশ্যই স্বর্গে যাব।
আচ্ছা আচ্ছা। তা আপনিই যে ডোনাল্ড ট্রাম্প, তার কি কোনো প্রমাণ আছে?
আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, আমি তো কাউকে প্রমাণ দেখাই না, সবাই আমাকেই প্রমাণ দেখায়।
তা ঠিক। কিন্তু এর আগে আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো—তাঁরাও প্রমাণ দেখিয়েই ভেতরে ঢুকেছেন। আপনাকেও দেখাতে হবে।
ট্রাম্প বললেন, ‘আইনস্টাইন, পিকাসো! এরা আবার কারা?’
প্রহরী বলে উঠল, ‘বুঝেছি বুঝেছি। আপনিই ট্রাম্প। যান, ভেতরে ঢুকতে পারেন।’
কথা দিয়ে, আচরণ দিয়ে প্রমাণ করি, আমরা কে?
কিন্তু কাচ্চি বিরিয়ানির প্লেটে হাড়ের আকার দেখে কেউ কি বলে দিতে পারে, এটা কোন চতুষ্পদীর মাংস? এটা কি সম্ভব? মাত্র দুই দিন আগে ঢাকার সবচেয়ে দামি ক্লাবে গিয়ে দাওয়াতে কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়েছি এবং যে হাড় পেয়েছি, তা ফেসবুকে প্রকাশিত চিকন হাড়ের ছবির চেয়েও চিকন। খাসির পাঁজরের হাড় চিকনই হয়।
আপনারা যাঁরা প্রসঙ্গটা ধরতে পারছেন না, তাঁদের বলি, সম্প্রতি ঢাকার একটা কাচ্চি বিরিয়ানির বিখ্যাত রেস্তোরাঁর বিরিয়ানির মাংস ও হাড়ের ছবি দেখিয়ে একজন দাবি করেছে, এই হাড় এত চিকন যে একটা খাসির মাংস হতেই পারে না। তাই নিয়ে ধুন্ধুমার লেগে যায়। নেটিজেনরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং প্রত্যেকেই এ বিষয়ে একটা স্ট্যাটাস লেখাকে কর্তব্য বলে মনে করতে থাকে। পরে কর্তৃপক্ষ ঘটনার তদন্ত করে এবং রায় দেয় যে এ অভিযোগ সত্য নয়।
এ প্রসঙ্গ ধরে বলতে পারি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক হাতে পেয়ে এটা দিয়ে কী করা উচিত, আমরা যেন বুঝে উঠছি না। আমরা যারা সংবাদমাধ্যমে কাজ করি, আমাদের শেখানো হয়েছে, কোনো লেখা লেখা নয়, যতক্ষণ না তা সম্পাদিত হচ্ছে। কোনো খবর খবর নয়, যতক্ষণ না বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বারবার যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে। সম্পাদকেরা বার্তা সম্পাদকদের পরামর্শ দেন, কোনো খবর এলে প্রথম কাজ হবে খবরটার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করা, তা নিয়ে যত ধরনের প্রশ্ন থাকতে পারে, সেসব উত্থাপন করা। সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যখন তুমি নিশ্চিত হবে খবরটা সত্য, তারপরেই কেবল তা প্রকাশ করতে পারো, তার আগে নয়।
হাড়ের আকার দেখে কীভাবে বুঝবেন আদি প্রাণীটি কী ছিল। ‘বাঙালির হাসির গল্প’ বলি। এক গ্রাম্য ডাক্তার রোগী দেখতে গেছেন। রোগীর নাড়ি টিপতে টিপতে তিনি বললেন, পেটে ব্যথা কেন? রাতে কি লিচু একটু বেশি খাওয়া হয়ে গিয়েছিল?
রোগী লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, জি, একটু বেশিই লিচু খেয়েছিলাম।
ডাক্তারের শাগরেদ ডাক্তারকে পরে জিগ্যেস করল, ‘ওস্তাদ, কীভাবে নাড়ি টিপে বলে দিলেন রোগী আগের রাতে লিচু খেয়েছিল।’
‘আরে গাধা, ওর বিছানার নিচে লিচুর খোসা আর বিচি পড়ে ছিল। নাড়ি টিপে বলিনি।’
পরে শাগরেদ নিজেই গেল রোগী দেখতে। রোগীর নাড়ি টিপতে টিপতে বলল, কাল রাতে স্যান্ডেল কি একটু বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়েছিল?
অতএব—‘বিফোর ইউ স্পিক, আস্ক ইউরসেলফ: ইজ ইট কাইন্ড, ইজ ইট ন্যাসেসারি, ইজ ইট ট্রু, ডাজ ইট ইম্প্রুভ দ্য সাইলেন্স?’
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক