সম্প্রতি একের পর এক কর ছাড়ের প্রজ্ঞাপন জারি হচ্ছে। চাল, চিনি, তেল, পেঁয়াজ—সবই পেল ছাড়। কিন্তু ভোক্তা কি মূল্যস্ফীতির প্রভাব থেকে ছাড়া পেল? যদি করই একমাত্র ভিলেন হতো, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য এককভাবে দায়ী হতো, তবে তো সেই ভিলেনের মৃত্যু হলেই দাম কমে আসার কথা। তা কি কখনো হয়েছে? যদি না হয়, তবে কেন কোনো সমস্যা সমাধানে সর্বাগ্রেই কর ছাড়ের প্রস্তাব তোলা হয়? এর কারণ হলো, অন্য যত বিচ্যুতি আছে, তার মধ্যে কর কমানো সহজ উপায়। সরবরাহব্যবস্থা, মার্কেট সিন্ডিকেট, অবৈধ মজুতদার, পরিবহন ব্যয় নানা ফ্যাক্টরের মধ্যে কর বেচারাই কেষ্ট। যাহা কিছু চুরি যায়, কেষ্ট ব্যাটাই চোর।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ওপর কর থাকা উচিত কি না, সেটা অন্য বিতর্কের বিষয়। নীতিনির্ধারকেরা যেকোনো সময় চাইলেই কর অব্যাহতি দিতে পারেন। একেবারে তুলে দিতে পারেন সব কর। কিন্তু তা হয় না কেন জানেন? প্রতিবছর পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, চিনি থেকে আদায় হয় প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা। দুর্বল অভ্যন্তরীণ রাজস্বব্যবস্থা এই চাপ নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। একেই দেশের কর জিডিপি নিয়ে নানা মহলের নানা হতাশা। তারপর যদি একের পর এক কর তুলে দেওয়া হয়, স্বল্প মেয়াদে তার প্রভাব হবে ভয়াবহ। দেশ চালাতে প্রতিনিয়ত অর্থের প্রয়োজন হয়। হুট করে এত বড় শূন্যতা সামাল দেওয়ার মতো কোনো খাত বা কর আদায় ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই কর ন্যায্যতার প্রশ্ন এখানে খাটে না।
যে দেশে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৫০ লাখ আয়কর দাতা, সে দেশে করের ন্যায্যতা সহজে নিশ্চিত করা কঠিন। দেশের কর জিডিপি হার ৭ দশমিক ৯, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম। প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে, পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সব অর্থ বিনিময় হবে ডিজিটাল মাধ্যমে। নানা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এই দুর্বল কর কাঠামোর প্রেক্ষাপটে কার্যকর নয়। আদর্শ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ই আদর্শ করব্যবস্থা কার্যকর করা যায়।
কিছুদিন আগে স্টক মার্কেটের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে জানতে চাইলাম, কর কত নম্বর ভিলেন? সবাই এক বাক্যে জানালেন, এক নম্বর; কেননা, এর একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আছে। কর–সংস্কৃতি যেহেতু গড়ে ওঠেনি, তাই এক হাজার টাকার ফাস্ট ফুড খেতে অসুবিধা নেই; কিন্তু এক শ টাকা কর দিতে অসুবিধা আমাদের। মনস্তাত্ত্বিক বাধা যে দেশের অর্থনীতির পঙ্গুত্বের কারণ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে, তা অনুধাবন জরুরি। বিনিয়োগকারীরা ভেবে নেন, তাঁদের ওপর কর আছে, তাই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা যাবে না। এই খোঁড়া যুক্তি অর্থনৈতিক বাস্তবতায় খাটে না। তবে এ ছাড়া অন্য জোরালো যুক্তি থাকলে দুর্বল পুঁজিবাজার সচলে কর ছাড় বিবেচনা করা যেতেই পারে। মন চেয়েছে কর দেব না বা ধারণাপ্রসূত করভীতির যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ জরুরি। কর যদি ছাড় দেওয়া হয়, তা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত হওয়া উচিত। বছরের পর বছর কর ছাড়ের গদির ওপর শুয়ে আরাম করার দিন আর নেই। দেশের স্টক মার্কেট বা নিত্যদ্রব্যের ওপর কর ছাড় যদি দিতে হয়, তার সঠিক বিশ্লেষণ করে দেওয়া উচিত, যাতে কর ছাড়ের সুবিধা ভোক্তা বা বিনিয়োগকারী পান। অসাধু মহলের পকেটে আপনার–আমার করের টাকা চলে যায়। দিনের পর দিন কর ছাড় দেওয়া হয়, কিন্তু কর ছাড়ের পর দাম কমেছে নাকি উল্টো বেড়েছে, তা দেখা হয় না। কর ছাড় নিয়ে এক মহলের দারুণ ব্যবসাও হয়। বন্দরে পণ্য এনে ফেলে রাখা হয় কর ছাড়ের অপেক্ষায়। যখন এলসি খোলা হয়েছে, তখন করসহ হিসেবে আমদানি হলেও কর ছাড়ের প্রজ্ঞাপন জারির পর পণ ছাড় হয়। বুঝতেই পারেন, এখানে বাণিজ্যের পরিমাণ কতটা ব্যাপক।
আমরা সবাই চাই দেশে কর আদায় বাড়ুক। কিন্তু নিজের ওপর বাড়ুক, তা চাই না। একে অন্যকে দেখিয়ে দিই। যাঁর ওপর কর আরোপ করা হয়, তিনিই বলেন, ‘শুধু আমিই কেন?’ এই ‘আমি আমি’ করেই কিন্তু আমরা, যাঁরা সঠিক কর দিতে চাই না। আবার যাঁরা কর দিতে চান, তাঁরাও নিরুৎসাহিত হন নানা হয়রানির জন্য।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবার আয়কর রিটার্ন অনলাইনে দেওয়ার প্রক্রিয়া জোরেশোরে শুরু করেছে। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কিছু পেশাজীবীদের জন্য। যদিও পুরো সিস্টেম এখনো তৈরি হয়নি, তথাপি সংযুক্তি ছাড়াই এবার রিটার্ন দাখিল করতে পারবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা। আয়কর অফিস যেতে হবে না। যদিও অনেক করদাতা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না। পরবর্তী সময় তাঁদের এই অনলাইন কর রিটার্ন নিয়ে কোনো জটিলতা হবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান তাঁরা। দেখা যাক, আশার কথা, শুরু তো হলো। মানুষ যদি বিশ্বাস করতে শুরু করেন, কর দিতে গেলে তাঁর অযথা ঝামেলা পোহাতে হবে না, এই মনস্তাত্ত্বিক বাধা হ্রাস পাবে। বাংলাদেশের মানুষের যে দেশপ্রেম আছে, তা জুলাইয়ের গণ–অভ্যুত্থানে আবারও প্রমাণিত। দেশের প্রয়োজনে কর দিতেও পিছপা হবেন না। শুধু মনের বাধাটা দূর করলেই চলবে।
দৌলত আকতার মালা, সংবাদিক