ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তাণ্ডব চালিয়ে গেলেও ইউক্রেনের মানুষ ও তাদের মিত্ররা অসাধারণ সাহস ও দৃঢ়তা দেখিয়ে যাচ্ছে। তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধ চালানোর প্রায় দুই বছর পর এখন এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে, ইউক্রেনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও কিছু করার আছে এবং অবশ্যই তা করতে হবে।
জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশ ইউক্রেনকে প্রথম থেকে অসাধারণ উদারতার সঙ্গে সমর্থন দিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন সেই সমর্থন কোনো কোনো মহলের উৎসাহের কারণে ভাটা দেখা যাচ্ছে। আর রাশিয়া এটির জন্যই অপেক্ষা করছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) ইউক্রেনকে গত ডিসেম্বরের মধ্যে ১০ হাজার কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা সে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমাদের জব্দ করা রুশ সম্পদ ও তহবিল বাজেয়াপ্ত করার ধারণাটি আবার সামনে আসছে। রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করার পর দেশটির যে তহবিল স্থগিত (ফ্রিজ) করা হয়েছে, সে তহবিল বাজেয়াপ্ত করে ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়াটাই হবে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার একটি সম্ভাব্য সমাধান।
রুশ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করলে তা ইউক্রেনের মনোবল এবং আর্থিক অবস্থাকে চাঙা করবে। কিন্তু এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আটলান্টিকের উভয় পারের দেশগুলোর নীতিনির্ধারকেরা ভাবনায় পড়ে গেছেন।
নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে বলেছে, শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এ ধরনের নজির স্থাপন করা হলে তা অন্যান্য দেশকে চিন্তায় ফেলে দেবে এবং তারা তাদের তহবিল নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভে জমা রাখা বা ডলারে তহবিল গঠন করা থেকে বিরত থাকার কথা ভাববে।
কিন্তু ভবিষ্যতে তহবিল বাজেয়াপ্তের ভয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে অন্য সরকারগুলো ইতস্তত করবে বলে যে আশঙ্কা মার্কিন কর্মকর্তাদের মনে কাজ করছে, সেখানে কয়েকটি মূল বিষয় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। যেমন রাশিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ অন্য দেশগুলোর সম্পদের ওপর প্রভাব ফেলবে না। বড় কোনো যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে না, এমন দেশগুলোকে দেওয়া মার্কিন প্রণোদনায়ও কোনো অদলবদল আনা হবে না।
উপরন্তু, রাশিয়ার স্থগিত করে রাখা তহবিল বাজেয়াপ্ত না করার মাধ্যমে পশ্চিমের দেশগুলো প্রকারান্তরে এই বার্তা দিচ্ছে যে নৃশংস আগ্রাসন চালানো দেশগুলো চাইলেই আন্তর্জাতিক আইন ভাঙতে পারে এবং কৃতকর্মের জন্য তাদের কোনো ফল ভোগ করতে হয় না।
তাই জি-৭ নেতাদের যে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া উচিত, তা হলো কোনো দেশকেই এই সুযোগ দেওয়া হবে না। স্থগিত রুশ অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হলে অন্য বেপরোয়া খারাপ শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনে ভয় পাবে। এতে সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ শান্তি প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে। রাশিয়ার তহবিলের সম্ভাব্য বাজেয়াপ্তকরণ যদি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ব্যাংকে অর্থ জমা রাখতে ইচ্ছুক অন্যান্য দেশকে সত্যি সত্যি বিচলিত করত, তাহলে তার প্রভাব ২০২২ সালে রাশিয়ার তহবিল স্থগিত করে দেওয়ার পর পরই দৃশ্যমান হতো।
উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে বাইরের কোনো দেশই তাদের টাকা তুলে নেয়নি। এর একটি বড় কারণ হলো বিশ্বের সামনে প্রতিষ্ঠিত আর্থিক ব্যবস্থার নিরাপদ বিকল্প খুব কমই আছে।
ধরে নিলাম, নানা দেশের সরকার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ অথবা জাপানে তাদের সম্পদ গচ্ছিত রাখতে ভয় পাচ্ছে। তাহলে তাদের সামনে বিকল্প কী ব্যবস্থা আছে? এমনকি যদি তারা তাদের পুঁজি নিয়ন্ত্রিত হওয়ার আশঙ্কায় থাকেও, তাহলেও কি তারা দেশের অভ্যন্তরে অর্থ রাখবে?
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো কি নিজ দেশে তহবিল জমানোর বিষয়ে নিরাপদ বোধ করবে? বরং ‘দুর্বৃত্ত’ দেশগুলো যদি যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ জমা না (যাদের সঞ্চয়ের পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ক্ষেত্রে খুবই নগণ্য) করে, তাহলে ইউরোপ ও জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর লাভ করতে পারবে।
এ কারণে রাশিয়াকে জবাবদিহির আওতায় আনতেই হবে। রাশিয়া ইউক্রেনে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ক্ষমতা মস্কোর নেই। তবে ইউক্রেনের নিম্নতম ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা এবং সেখানকার বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করতে রাশিয়ার জব্দ করা অর্থ বাজেয়াপ্ত করে তা কাজে লাগানো যেতে পারে।
ইউক্রেনে রাশিয়া যে সম্পদহানি করেছে, তা ক্রেমলিনকে শেষ পর্যন্ত দিতে বাধ্য করা উচিত। জব্দ করা রুশ তহবিল বাজেয়াপ্ত করাকে ইউক্রেনের সেই ক্ষতিপূরণের একটি ডাউন পেমেন্ট বা কিস্তি হিসেবে দেখা যেতে পারে।
● জোসেফ ই স্টিগলিৎজ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং
● অ্যান্ড্রু কোসেনকো ম্যারিস্ট কলেজের স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অর্থনীতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট