অ্যারিস্টটল মানুষকে সেরা ‘রাজনৈতিক প্রাণী’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন, কারণ মানুষ মতপ্রকাশ করতে সক্ষম এবং কোনটি ন্যায় ও অন্যায়, সে সম্পর্কে তার ধারণা আছে। আজকের বাংলাদেশে অ্যারিস্টটলের সেই সেরা ‘রাজনৈতিক প্রাণী’র রাজনৈতিক বিবর্তন ঘটেছে।
তবে সেটি প্রকৃতির অবদানে নয়, বরং জাগতিক বস্তুর প্রতি মানুষের লোভ, লালসা ও স্বার্থপরতা থেকে। এই রাজনৈতিক বিবর্তনে দেশের শিক্ষকসমাজ সবচেয়ে এগিয়ে। একজন শিক্ষক যখন রাজনীতির কাছে আদর্শ বিকিয়ে দেন, রাজনীতিকে ব্যক্তিস্বার্থ অর্জনের হাতিয়ার কিংবা ওপরে ওঠার সিঁড়ি বানান এবং কাউকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন, তখন তিনি আর শিক্ষক থাকেন না, হয়ে যান একজন ‘বিবর্তিত রাজনৈতিক প্রাণী’।
দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন এসব নব্য বিবর্তিত রাজনৈতিক প্রাণীর সবচেয়ে বড় চিড়িয়াখানা। এখানে অধিকাংশ শিক্ষক এখন কোনো না কোনো লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনের রেজিস্ট্রিকৃত সদস্য। আমার জানামতে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে দলীয় শিক্ষকরাজনীতির এই ব্যাপকতা ও বাহুল্য নেই। শিক্ষকরাজনীতির কোনো র্যাঙ্কিং থাকলে নিঃসন্দেহে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ শিক্ষকরাজনীতিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হতো।
আজকাল অনেক শিক্ষক একেবারে রাখঢাক না করেই তোষামোদির রাজনীতিতে নামছেন। রাজপথে রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দিচ্ছেন, ভোটের সমাবেশে বক্তৃতা দিচ্ছেন, টক শোতে এসে চাটুকারিতা করছেন, পথেঘাটে দলীয় প্রার্থীর জন্য ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। এমনকি অতি উৎসাহী কিছু শিক্ষক দলীয় পদপদবি নিচ্ছেন, রাজনৈতিক দলের জাতীয় কাউন্সিলের বিজ্ঞাপনে নিজের ছবি সংযুক্ত করে ফেসবুকের প্রোফাইলে দিচ্ছেন। বিষয়গুলো একজন শিক্ষকের মর্যাদা বা আদর্শের সঙ্গে মোটেও সংগতিপূর্ণ কিংবা শোভনীয় নয়।
১৯৭৩ সালের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ শিক্ষকদের স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, বিবেক দ্বারা পরিচালিত হওয়ার অবাধ সুযোগ দিয়েছে। এ স্বাধীনতা মানে এই নয় যে শিক্ষক রাজনৈতিক কোনো দল বা বিশেষ গোষ্ঠীর কাছে মাথা নত করবেন, তাদের তুষ্ট করার জন্য আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবেন। কিন্তু রাজনীতির রং গায়ে মেখে আলোকিত ও বিবেকবান মানুষগুলো দুঃখজনকভাবে আজ ‘একচোখা বুদ্ধিজীবী’ কিংবা ‘সুবিধাবাদী প্রাণী’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন, সামান্য ব্যক্তিস্বার্থের কাছে মাথানত করে দলীয় আদর্শের তোষামোদি করছেন।
যেখানে বাঙালি জাতি রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে, অসংখ্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, সেখানে শিক্ষকদের এই স্বেচ্ছাপরাধীনতা ও শৃঙ্খলিত হওয়া শিক্ষকসমাজের জন্য যেমন অবমাননাকর, তেমনি জাতির জন্যও চরম হতাশার।
রাষ্ট্রের প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে, থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। শিক্ষকের ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্য। তবে শিক্ষকরাজনীতির নামে শিক্ষাঙ্গনে যে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির চর্চা চলছে, সেটি শিক্ষার পরিবেশ ও মান উন্নয়নে কিংবা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নতিতে কতটুকু অবদান রাখছে বা জাতির জন্য কতটুকু কল্যাণ বয়ে আনছে, সে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে।
শিক্ষক হবেন একজন সচেতন নৈতিক আদর্শসম্পন্ন ব্যক্তি, যাঁর আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধির ক্ষমতা আছে। ঐতিহাসিকভাবে জাতির দুর্দিনে শিক্ষকসমাজ অভিভাবকের ভূমিকায় জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে বাতিঘর হিসেবে ভূমিকা রেখেছে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে জাতিকে টিকে থাকার সাহস জুগিয়েছে
অনেকে মনে করেন, উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকরাজনীতি প্রধান অন্তরায়। শিক্ষকরাজনীতির চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থানীয় রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবের অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং বিস্তৃত হচ্ছে। তা ছাড়া শিক্ষাঙ্গনে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের যে নৈরাজ্য চলছে, তার পেছনে শিক্ষকরাজনীতিরও প্রভাব থাকে। দুঃখজনকভাবে একজন শিক্ষার্থী তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ঠিক করছেন শিক্ষকের রাজনৈতিক পরিচয় দেখে, এমনকি ভিন্নমতের কোনো শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে বা দেখা করতে পর্যন্ত তাঁকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
শুধু শিক্ষার্থী নন, তাঁদের অভিভাবকেরাও শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা, নিপীড়ন, নিয়োগ–বাণিজ্য নিয়ে শঙ্কিত। তাঁরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষকতা ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবেন, তাঁদের ছায়ায় এসে শিক্ষার্থীরা আলোকিত হবেন, দেশপ্রেমের প্রেরণা পাবেন, নিজেকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার উৎসাহ পাবেন, সত্যকে অন্তরে ধারণ করে বুকে সাহস নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা পাবেন। কিন্তু শিক্ষাঙ্গনে আজকাল যা ঘটছে, তা অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত।
শিক্ষক হবেন একজন সচেতন নৈতিক আদর্শসম্পন্ন ব্যক্তি, যাঁর আত্মজ্ঞান ও আত্মোপলব্ধির ক্ষমতা আছে। ঐতিহাসিকভাবে জাতির দুর্দিনে শিক্ষকসমাজ অভিভাবকের ভূমিকায় জাতিকে সঠিক পথ দেখাতে বাতিঘর হিসেবে ভূমিকা রেখেছে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে জাতিকে টিকে থাকার সাহস জুগিয়েছে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ষাটের দশকে শিক্ষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম, গণ-অভ্যুত্থান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম—প্রতিটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে শিক্ষকসমাজ সাহসী ও সোচ্চার ভূমিকা রেখেছে। সেই শিক্ষকসমাজ কালের পরিক্রমায় নিজেদের গর্বিত অতীত ভুলে দলীয় রাজনীতির অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে।
দিন দিন শিক্ষার্থীদের কাছে সম্মান হারাচ্ছে, সমাজের কাছে মর্যাদা হারাচ্ছে। আজকে শিক্ষকদের যেটুকু সামাজিক মর্যাদা অবশিষ্ট, সেটি তাঁদের অর্জন নয়, বরং তাঁদের পূর্বসূরিদের ত্যাগ ও মহৎ কাজের ফসল।
শিক্ষককে থাকতে হয় একজন বিচারকের ভূমিকায়। তিনি নিজেই যদি প্রকাশ্যে একটি পক্ষ নেন, তাহলে জাতি তাঁর কাছ থেকে কী আশা করতে পারে। তিনি কীভাবে তাঁর একাডেমিক ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ন্যায়নিষ্ঠতা বজায় রাখবেন। এ কারণে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা কিংবা যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক দলের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর আজ্ঞাবাহীতে পরিণত হচ্ছেন, নিজেদের মধ্যে দলীয় আনুগত্যের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন।
একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হলো তাঁর সততা ও নৈতিকতা। সেই বড় শক্তির জায়গাতেই আজ বড় গলদ। চোখের সামনে সন্তানতুল্য কোনো শিক্ষার্থী আক্রান্ত হলেও শিক্ষক এগিয়ে আসছেন না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিপীড়ন চলছে, নির্যাতন চলছে, শিক্ষকসমাজ সেসব নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে না।
দিন দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পেশিশক্তি, মাস্তানি, চাঁদাবাজি ও দখলদারি ব্যাপক আকার ধারণ করলেও বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষকসমাজ অনেকটাই ভাবলেশহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক সংগঠনকে এ বিষয়ে জোরালো প্রতিবাদ বা উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করতে দেখা যায় না। শিক্ষাঙ্গনের শীতল ছায়াতলে শিক্ষার্থীরা যদি সত্যিকার মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে না ওঠে, তাহলে যে প্রশ্ন বারবার উঠবে, এই শিক্ষকরাজনীতি দিয়ে জাতির লাভ কী?
ড. ফরিদ খান অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়