এ এক বিরাট স্বস্তির বিষয়। ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি তার নতুন নেতা হিসেবে একজন মেধাদীপ্ত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছে। ঋষি সুনাকের নির্বাচন ব্রিটেনকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং সর্বকনিষ্ঠ (৪২ বছর বয়সে) প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়ার গৌরব দিয়েছে। একই সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আধুনিক সময়ের ব্রিটেনের সবচেয়ে ধনী প্রধানমন্ত্রীও তিনি। কিন্তু তাঁর চেয়েও বড় কথা হলো, তিনি বরিস জনসন কিংবা লিজ ট্রাসের মতো নেতা নন।
বোঝাই যাচ্ছে, ঋষি সুনাকের কাজ খুব সহজ হবে না। কিন্তু মেহেরবানি করে আমাদের, মানে ইংরেজদের তাঁর নির্বাচনের ইতিবাচক দিকগুলোকে উদ্যাপন করতে দিন। কারণ, তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা বরিস জনসনের প্রত্যাবর্তনের বুলেট থেকে নিজেদের বাঁচাতে পেরেছি।
তিনি যদি ফিরে আসতেন, তাহলে তা আমাদের গণতন্ত্রের জন্য ধ্বংসাত্মক হতো; কারণ তখন প্রকারান্তরে এটিই প্রমাণিত হতো যে আইন ভঙ্গ করা এবং নৈতিক মূল্যবোধকে পাত্তা না দেওয়াটা এ পদের জন্য আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।
জনসনের প্রত্যাবর্তন তাঁর নিজের দলের মধ্যেও অস্বস্তি তৈরি করত। কারণ, মাত্র ১৬ সপ্তাহ আগে তিনি চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর সরকারের ৬০ জন সদস্য ইস্তফা দিয়েছিলেন। এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেই পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে আবার গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন—এটি জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতো না।
অযৌক্তিকভাবে কিছু টোরি ঋষি সুনাককে ‘সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এর কারণ তিনি কোভিড-১৯ মহামারির সময় চ্যান্সেলর অব এক্সচেকার থাকাকালে সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে উদার আয়-সহায়তা কর্মসূচি তৈরি করেছিলেন এবং অল্প কিছুদিন আগে তাঁর পূর্বসূরি লিজ ট্রাসের ব্যাপক মাত্রার কর কাটছাঁটের বিরোধিতা করেছিলেন। তবে আমাদের বেশির ভাগই তাঁর এ উদ্যোগকে বুদ্ধিদীপ্ত বলে রায় দেবেন। মি. সুনাক ব্যক্তি হিসেবে শালীন এবং রাজনীতিক হিসেবে সৎ। তিনি প্রথম থেকেই ব্রেক্সিটের সমর্থক ছিলেন এবং মহামারি চলাকালে লকডাউনের বিরোধিতা করেছিলেন। হয়তো এ কারণেই তাঁকে সাধারণত ডানপন্থী হিসেবে মনে করা হয়, যদিও তিনি গোঁড়া চরিত্রের নন। তাঁকে সম্ভবত ডানপন্থী বাস্তববাদী হিসেবে বর্ণনা করাটাই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত হবে।
এর বাইরে সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ব্রিটিশ সমাজের পরিপক্বতাকে আরেক দফা প্রমাণ করল। সুনাকের মা–বাবা ১৯৬০–এর দশকের গোড়ার দিকে পূর্ব আফ্রিকা থেকে ব্রিটেনে এসেছিলেন এবং সুনাক বর্তমানে হিন্দুধর্ম পালন করেন। তাঁর এ জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় তাঁর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে বাধা হতে পারেনি।
অর্থাৎ তাঁর জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্ব বহন করেনি। এটি ব্রিটেনের জনগণের সাংস্কৃতিক পরিপক্বতাকে সামনে তুলে ধরবে। যুক্তরাজ্যের সাম্প্রতিক রক্ষণশীল সরকারগুলোতে আফ্রিকান এবং দক্ষিণ এশীয় মা–বাবার ছেলেমেয়েতে ভরে যেতে দেখা যাচ্ছে। তাঁদের কেউ সফল হয়েছেন, কেউ হননি; কিন্তু তাঁদের জাতিগত উৎস তাঁদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সামান্যই ভূমিকা রেখেছে।
জনসন ও ট্রাস উভয়ই ডানপন্থী। ইউরোপবিরোধী টোরিদের সমর্থন ধরে রাখার জন্য তাঁরা দুজনই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে করা উত্তর আয়ারল্যান্ড চুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়েছিলেন। সুনাক তাঁদের চেয়ে নমনীয় কূটনৈতিক পদ্ধতির পক্ষে বলে মনে হচ্ছে; যদিও তাঁর সেই ডানপন্থীদের সমর্থনও দরকার হবে। তবে তাঁর প্রথম কাজ হবে আর্থিক বাজারকে স্থিতিশীল করা।
সুনাকের জন্য আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তিনি একজন অতি ধনী ব্যক্তি। তাঁর ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্ত্রী অক্ষতা নারায়ণমূর্তি ভারতীয় ডিজিটাল পরিষেবা সংস্থা ইনফোসিসের অন্যতম সহপ্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তির কন্যা। সেই সুবাদে এ প্রতিষ্ঠানের মূলধনের বেশির ভাগের মালিক অক্ষতা।
ঋষি সুনাক আগে থেকেই যথেষ্ট ধনী ছিলেন। তিনি বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগ কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাক্স-এ কাজ করতেন। কিন্তু অক্ষতাকে বিয়ের সুবাদে তিনি আর্থিক সমৃদ্ধির একেবারে চূড়ায় চলে যান। এটি তাঁকে সমালোচনার মুখে ফেলবে। অনেকেই বলবেন, সাধারণ মানুষের জীবন সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই।
রক্ষণশীল টোরিরা ঐতিহ্যগতভাবে দাবি করে থাকে, তারা আইনশৃঙ্খলা এবং মূল্যবোধ অনুসরণে দৃঢ়। কিন্তু বরিস জনসনের উল্টোপাল্টা আচরণ এবং হরেদরে নিয়ম ভঙ্গ করা টোরিদের সেই দাবিকে অসম্মানিত করেছে। অন্যদিকে লিজ ট্রাসের বেপরোয়া রাজস্বনীতি এ ধারণাকে ধ্বংস করেছে যে টোরিরা অর্থনীতির নিরাপদ পরিচালক।
এ দুটির যেকোনো একটি ইমেজ পুনরুদ্ধার করা সুনাকের জন্য কঠিন হবে। সেটি তিনি করতে পারবেন কি না, তা বলা যাচ্ছে না। তবে একটি বিষয় নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে, সেটি হলো প্রধানমন্ত্রী সুনাকের অধীনে যুক্তরাজ্য রাশিয়ান সেনাদের ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে তাড়ানোর বিষয়ে ইউক্রেনের পাশে থাকবে—তাঁর এ বিদেশনীতিকে উভয় প্রধান রাজনৈতিক দল এবং রক্ষণশীলদের সব উপদল সমর্থন করছে।
তবে সুনাকের সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কোন পন্থায় সম্পর্ক পরিচালনা করবে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের উত্তর আয়ারল্যান্ডের প্রদেশের মর্যাদাবিষয়ক সংবেদনশীল ইস্যুটি তারা কীভাবে সামাল দেবে, তা খুব স্পষ্ট নয়।
জনসন ও ট্রাস উভয়ই ডানপন্থী। ইউরোপবিরোধী টোরিদের সমর্থন ধরে রাখার জন্য তাঁরা দুজনই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে করা উত্তর আয়ারল্যান্ড চুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়েছিলেন। সুনাক তাঁদের চেয়ে নমনীয় কূটনৈতিক পদ্ধতির পক্ষে বলে মনে হচ্ছে; যদিও তাঁর সেই ডানপন্থীদের সমর্থনও দরকার হবে। তবে তাঁর প্রথম কাজ হবে আর্থিক বাজারকে স্থিতিশীল করা।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
বিল এমমোট দ্য ইকোনমিস্ট-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক এবং দ্য ফেট অব দ্য ওয়েস্ট বইয়ের লেখক