একটি ভবন নির্মাণে সুদক্ষ নকশাবিদ (আর্কিটেক্ট) যেমন দরকার, তেমনি সুদক্ষ স্ট্রাকচারাল ডিজাইনার অপরিহার্য। নকশা ও ডিজাইন অনুসারে মাঠপর্যায়ে কাজটি সম্পন্ন করতে ভালো সাইট ইঞ্জিনিয়ারও থাকতে হবে। একটি ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করতে রাজমিস্ত্রি, স্যানিটারি বা প্লাম্বারমিস্ত্রি, ইলেকট্রিকমিস্ত্রি, টাইলমিস্ত্রি, থাই গ্লাসমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি কারও অবদান বা দক্ষতাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। হোয়াইট কলার লেবার আর ব্লু কলার লেবার সবাই গুরুত্বের।
ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মী দেশে বা বিদেশে যেখানেই কাজ করুন না কেন, দক্ষতায় পিছিয়ে থাকা লোক হয় কম মূল্যায়িত হবে না হয় কাজ থেকে ছিটকে পড়বে। বিদেশের ক্ষেত্রে অন্য দেশ থেকে আসা কর্মীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকতে হয়। শুধু টিকে থাকলেই চলে না, অবমূল্যায়ন যাতে না হয়, তার নিশ্চয়তা থাকতে হয়। কিন্তু সবকিছুর মূলে থাকে দক্ষতা। অদক্ষ লোক পদে পদে হেনস্তার শিকার হন। একই কাজে অন্য দেশের লোক যখন মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা পান, তখন অদক্ষ লোকটি কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন।
ফিলিপাইন বা ভিয়েতনামি প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে বিদেশের মাটিতে কাজ করার সময় তাঁদের দক্ষতার চেয়ে আমাদের কোথায় যেন ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। বেতন-ভাতার ব্যবধানও অনেক, যা চোখে পড়ার মতো। আমাদের চেয়ে কমসংখ্যক ফিলিপিনো প্রবাসী হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের বছরে রেমিট্যান্স আমাদের থেকে দেড় গুণেরও বেশি। কারণটা হলো তাঁরা স্কিলড লেবার হিসেবে পৃথিবীব্যাপী সুনাম কুড়িয়েছেন।
আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার বা ওকালতি যে পেশারই হোক না কেন, একটি পেশাদারি পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে ওই পেশার জন্য উপযুক্ত প্রমাণ করতে হবে। এবং সেই মতে লাইসেন্স পেতে হবে। এমন প্রথা জাপানসহ বেশির ভাগ দেশে চালু আছে। অদক্ষ ডাক্তারের হাতে যেমন একজন রোগীর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তেমনি অদক্ষ প্রকৌশলীর হাতে একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মিত হয়ে কয়েক শ বা হাজার লোকের জীবন বিপন্ন হতে পারে। যার দুঃখজনক উদাহরণ ২৪ এপ্রিল ২০১৩ রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৪টি তাজা প্রাণ ঝরে পড়া। এ জন্যই স্টিয়ারিং ধরার আগে একজন গাড়িচালকের যেমন পর্যাপ্ত দক্ষতা থাকা দরকার তেমনি যে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের ডিজাইন করা ভবনে শত বা হাজার লোক থাকে তার উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকতে হবে। দক্ষতা প্রমাণ করতে কঠিন পরীক্ষার বিকল্প নেই।
সর্বস্তরের পেশাজীবীর উপযুক্ত দক্ষতা থাকা দেশ ও বিদেশে কাজ করার জন্য অপরিহার্য। দক্ষ কর্মিবাহিনী তৈরি করার মাধ্যমে বাংলাদেশে বর্তমানের রেমিট্যান্সের পরিমাণ কম হলেও দ্বিগুণ করতে পারে। পেশাজীবীদের কাছ থেকেই ফি নিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। শুধু প্রয়োজন উদ্যোগের। একটা সিস্টেমে আসতে হবে। বর্তমানে যা আছে, তা কার্যকর নয়। এমনকি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে একটি এক্স-রে মেশিন যে চালাচ্ছেন, তাঁর গলায় আইডি কার্ড দেখা যায় না। কী তাঁর পরিচয়, তা জানার অধিকার রোগীর থাকলেও তিনি জানতে পারলেন না কে কী যোগ্যতার বলে তাঁর এক্স-রেটা করলেন।
ভবনের নকশা করা যেমন গুরুত্বের, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বের কাঠামোর ডিজাইন। একজন কাঠামো প্রকৌশলীকে পেশাজীবী হতে হলে একটি প্রফেশনাল পরীক্ষা পার হতে হবে। তার আগে নির্দিষ্ট বছরের ইন্টার্ন কোর্স শেষ করতে হবে ও নির্দিষ্ট বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। তারপর পেশাজীবী হওয়ার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। উত্তীর্ণ হলে নামের সঙ্গে নিজের পরিচয় দেওয়ার জন্য এসই (স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার) ব্যবহার করবেন।
পেশাদারি কোনো কাজে অংশগ্রহণ করলে একটা আইডি কার্ড গলায় ঝুলে থাকবে। এমনিভাবে ভবনের নকশায় পেশাদার স্থপতি নামের সামনে পিই (প্লানার আর্কিটেক্ট) বা এমন কিছু ব্যবহার করবে। এভাবে কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন ইঞ্জিনিয়ারের নামের সামনে সিএসই লেখা থাকবে। মোটকথা কোনো বিষয়ের ওপর পেশাজীবী হতে হলে ওই বিষয়ে নির্ধারিত পরীক্ষায় পাস করে একটা আইডি কার্ড গলায় ঝোলাতে হবে। যিনি গলায় আইডি কার্ড ঝোলাতে পারবেন না, তাঁর পক্ষে কোনো পেশাজীবী কাজ করা চলবে না। ফিলিপিনোদের মতো দক্ষ জনবলের নাম কুড়াতে হলে আইডি কার্ড ঝোলানোর যোগ্যতা থাকতে হবে।
বর্তমানে দেশে রাজমিস্ত্রি, স্যানিটারি বা প্লাম্বারমিস্ত্রি, ইলেকট্রিকমিস্ত্রি, টাইলমিস্ত্রি, থাই গ্লাস মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি বা একজন গাড়ির ড্রাইভার ‘ওস্তাদ’–এর কাছ থেকে কাজ করার মধ্য দিয়ে শেখেন। যার ফলে তাঁরা হচ্ছেন অদক্ষ, না হয় অর্ধদক্ষ কর্মী। এঁদের পক্ষে জাত মিস্ত্রি হওয়া কোনো দিনও সম্ভব হয় না। বিদেশে বসে কোনো তৃতীয় দেশের লোকজনদের কাছে টিকতে না পেরে এঁরা কম বেতনে চাকরি করেন। আমাদের দেশ রেমিট্যান্সে ভালো করতে পারছেন না এ জন্যই। তাই দেশের ৬৪টি জেলা শহরে একটা করে প্রশিক্ষণকেন্দ্র থাকবে যেখানে রাজমিস্ত্রি, স্যানিটারি বা প্লাম্বারমিস্ত্রি, ইলেকট্রিকমিস্ত্রি, টাইলমিস্ত্রি, থাই গ্লাস মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি যে যাঁর পেশা অনুসারে তিন বা ছয় মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্স শেষ করবেন।
পেশাদার নন এমন শ্রমিকদেরও কম হলেও এক মাস প্রশিক্ষণ দরকার। কোর্সের মধ্যে নিরাপত্তার বিষয়টি ভালোভাবে থাকতে হবে। কারণ, নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় থাকে না বলে শ্রমিকদের দুর্ঘটনার হার বেড়ে গেছে। তারপর বসতে হবে একটি কঠিন পরীক্ষায়। পাস করলে গলায় ঝুলবে আইডি কার্ড। কার্ডে যে ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তার নাম ও ব্যাপ্তিকাল উল্লেখ থাকবে। এমন দক্ষ কর্মীরা দেশ গড়ার কাজে ও বিদেশে উঁচু বেতনে কাজ করে রেমিট্যান্স প্রবাহে অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারবেন।
যেসব প্রকৌশলী উন্নত বিশ্বের পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকেন তাঁদের দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রয়োজন পড়ে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলতি নির্মাণ প্রজেক্টের ডিটেইল ডিজাইন (ডিডি) ও কনস্ট্রাকশন সুপারভিশনে (সিই) বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের খুব কম দেখা যায়। তবে খুব কমসংখ্যক হলেও তাঁরা দেশের রেমিট্যান্সে অবদান রাখছেন। কারণ, তাঁদের পরিবার দেশে রেখেই তাঁরা স্বল্পকালীন পরামর্শকের কাজে বিদেশ যান। তাঁদের মাসিক রেমিট্যান্স একজন শ্রমজীবীর চেয়ে কম হলেও ২০ গুণ। তাই এই পেশাজীবীর সংখ্যা বাড়ানোর দরকার। সে জন্য পেশাজীবী প্রকৌশলী তৈরি করার বিকল্প নেই। যাঁদের নামের সামনে থাকবে পিই বা এসই, গলায় থাকবে একটা অইডি কার্ড।
সর্বস্তরের পেশাজীবীর উপযুক্ত দক্ষতা থাকা দেশ ও বিদেশে কাজ করার জন্য অপরিহার্য। দক্ষ কর্মিবাহিনী তৈরি করার মাধ্যমে বাংলাদেশে বর্তমানের রেমিট্যান্সের পরিমাণ কম হলেও দ্বিগুণ করতে পারে। পেশাজীবীদের কাছ থেকেই ফি নিয়ে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব। শুধু প্রয়োজন উদ্যোগের। একটা সিস্টেমে আসতে হবে। বর্তমানে যা আছে, তা কার্যকর নয়। এমনকি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে একটি এক্স-রে মেশিন যে চালাচ্ছেন, তাঁর গলায় আইডি কার্ড দেখা যায় না। কী তাঁর পরিচয়, তা জানার অধিকার রোগীর থাকলেও তিনি জানতে পারলেন না কে কী যোগ্যতার বলে তাঁর এক্স-রেটা করলেন।
ড. আলী আকবর মল্লিক কাঠামো প্রকৌশলী ও ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ