আচ্ছা, বলুন তো শিক্ষায় বাংলাদেশ র্যাঙ্কিংয়ে কত? গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স ২০২৩ অনুসারে, আমরা ১৩৩টি দেশের মধ্যে ১১২তম। যেহেতু আমরা উন্নয়নের রোল মডেল, সবাই মনে করবে আমাদের চেষ্টা আছে টেকসই উন্নয়নে, যার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। কিন্তু আমাদের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ মাত্র ১.৭৬ শতাংশ, যেখানে ইউনেসকোর প্রস্তাব ছিল ৬ শতাংশ। নতুন শিক্ষাক্রম আসার পর যখন সবাই খুব হতাশ, এর মধ্যে আমাদের উচ্চশিক্ষায়ও দেওয়া হচ্ছে নতুন আঘাত!
বাংলাদেশ কারিগরি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ ১৫ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপন জারি করে কমিটি গঠন করে, দেশের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে তাঁদের বিএসসি (পাস) সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য। শিক্ষামন্ত্রী চাইছেন, তাঁদের মাধ্যমিকের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য (মার্চ ২, কালের কণ্ঠ)।
প্রজ্ঞাপনটি পড়ে শেখ সাদির একটি ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যখন মূর্খরা ‘উদ্ভট আদেশ’ জারি করে দেশ চালাবে। নির্বোধরা তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য গর্ববোধ করবে।
খুব জানতে ইচ্ছা করে যাঁদের চাকরিতে ২০ বছরের ওপর অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের কি এখন পিএইচডি দেওয়া হবে? আবার ধরেন যাঁরা মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আছেন, তাঁদের কি তিন বছর অভিজ্ঞতার পর এমবিবিএস সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হবে?
আমরা সবাই জানি, দেশের মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক ঠিকমতো কাজ করছে না। যার প্রধান কারণ অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় প্রয়োগ। যেখানে ডাক্তারদের দাবি, এই কাজ সিংহভাগই করে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টরা। অল্পবিদ্যা যে ভয়ংকরী, তা কে না জানে!
প্রজ্ঞাপনটি জারির পর এ বিষয়ে বিশ্বের অন্য দেশগুলায় দেখার চেষ্টা করলাম। কোথাও এ রকম উদ্ভট নিয়ম দেখলাম না। প্রকৌশলীরা কীভাবে কাজ করেন, নীতিনির্ধারকদের কি সেই অভিজ্ঞতা আছে? থাকবেই–বা কী করে, তাঁদের কজনেরই–বা এই নিয়ে পড়াশোনা আছে! ব্যুরোক্র্যাটরা তো সব সময়ই টেকনোক্র্যাটদের হেয় করেন।
নাথান ডব্লিউ ডগহারথি প্রকৌশলবিদ্যার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এটি বিজ্ঞান না, অঙ্ক না, সমাজবিজ্ঞান বা অন্য কোনো বইও না। কিন্তু প্রকৌশলীরা যেকোনো সমস্যা তাঁদের সব জ্ঞান এক করেই করেন।
আর আইজ্যাক আসিমভ তো আর এক কাঠি সরেস, তাঁর মতে, বিজ্ঞান অনেক মজার এবং আনন্দদায়ক, কিন্তু পৃথিবী বদল করেন বিজ্ঞানীরা নন, প্রকৌশলীরা, ওই বিজ্ঞানের সাহায্যেই।
বলা হয়ে থাকে, একজন ডাক্তারের ভুলে একসঙ্গে অনেক মানুষ মারা যেতে পারে কিন্তু একজন প্রকৌশলীর ভুলে সভ্যতা বিনষ্ট হতে পারে। বিশ্বাস হয় না? আমাদের কাছের হরপ্পা মহেঞ্জোদারো কিন্তু জলজ্যান্ত উদাহরণ। এখন এই জ্ঞান ছাড়াই আমরা কি উচ্চমাধ্যমিক সমমানের শিক্ষাক্রমের মানুষজনের হাতে সহজেই সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছি না?
ফরচুন ৫০০–এর ৩০ শতাংশ প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন প্রকৌশলীরা। আমাদের দেশেই কতজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা এই যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন? হ্যাঁ, অনেকেই নিজ নিজ কাজে দক্ষ। কিন্তু সমস্যা হলো ডিপ্লোমায় সব বিষয়ে স্নাতক মানের শিক্ষা দেওয়া হয় না। তাদের দিয়ে কীভাবে মাধ্যমিকে শিক্ষক–ঘাটতি পূরণ করা হবে! যারা মাধ্যমিকের উচ্চতর গণিত নিজেরাই পড়েনি, তারা কীভাবে এই শিক্ষা দেবে? যদি ডিপ্লোমা দিয়ে মাধ্যমিকের শিক্ষক খুঁজতে হয়, তাহলে দেশে এত বেকার স্নাতকদের অযোগ্যতার দায় কি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নেবে না?
প্রকৌশলীদের ও প্রকৌশল শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনমন দেশের টেকসই উন্নয়নের পথে অন্তরায়ই শুধু নয়, ভবিষ্যতের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তি তৈরি ও নলেজ–বেজড সোসাইটি বিনির্মাণে বড় প্রতিবন্ধকতা। যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নামে এই ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা বরং কোনো কাজে আসার থেকে আমাদের আরও পিছিয়ে ফেলবে। একটা কথা মনে রাখা উচিত, যার কাজে তাকেই সাজে। তাই অবিলম্বে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাতিল করে, শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশিদের শিক্ষা বা গবেষণা খাতে ভূমিকা খুব গৌণ। কিন্তু এখানেই ব্যতিক্রম প্রকৌশলীরা। প্রকৌশলীদের সেরা সম্মাননা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (এনএই) ফেলোশিপ (যাকে ইঞ্জিনিয়ারদের নোবেল বলা থাকেন অনেকে) এখন পর্যন্ত পেয়েছেন তিনজন বাংলাদেশি।
ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারের (আইইইই) প্রেসিডেন্ট ছিলেন একজন বাংলাদেশি। দেশের সবচেয়ে বেশি পোস্টডক্টরাল ডিগ্রিও হয়েছে প্রকৌশলীদের থেকে।
কয়েক দিন আগেই তো নাসার গবেষণায় এলো এক বাংলাদেশির নাম, যাঁকে নিয়ে মার্কিন দূতাবাস পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছে। বিদেশে অনেক বড় বড় প্রোজেক্টে আছে বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের অবদান, অন্তত টিম মেম্বার হিসেবে হলেও।
আমাদের সরকারিভাবে পাস করা প্রকৌশলীরা সরাসরি যেকোনো দেশে সরাসরি চাকরি পেতে পারেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁদের আইএলটিএস পর্যন্ত দেখে না। দেশে গবেষণা হয় না। কিন্তু যা হয় তার ৫০ শতাংশের ওপর থাকে প্রকৌশলীদের গবেষণাপত্র। বিদেশে পড়তে যত জন যান, এখানেও প্রকৌশলীরা সবার চেয়ে এগিয়ে। শুধু কি বিদেশ, আমাদের সাম্প্রতিক বিসিএস নিয়োগগুলোতেও প্রকৌশলীদের প্রাধান্য আমরা দেখি।
আমার নিজের একটা ইন্টারভিউ বোর্ডের কথা মনে পড়ে। আমার সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় সহকর্মী। তাঁর দুইটা প্রশ্ন ছিল, তোমার দেশে সবাই এসএসসি বা এইচএসসিতে জিপিএ–৫ কেন? এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা ছেলে ইন্টারভিউ দিয়েছিল, যার সিজিপিএ ছিল ৩.৮৭ ছিল। তার অবস্থা নিয়ে আসলে বলার মতো না। তাঁরা বলেছিলেন, তোমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে হলে জিপিএ–৫ আর এ রকম অকার্যকর বিশ্ববিদ্যালয়গুলা বন্ধ করতে হবে।
এ ছাড়া বেশ কিছু ভাইভাতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের নেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তাঁরা যা জানেন, তা অনেক সময় বলতেও পারেন না। তবে হ্যাঁ! যাঁরা কারিগরি শিক্ষা থেকে মাধ্যমিক পাস করে ডিপ্লোমা করে বিএসসি করেছেন, তাঁরা হাতের কাজে অনেক দক্ষ।
অনেকে বলেন সিলেবাস কাছাকাছি, তাঁরা ডুয়েট থেকে পাস করা সিনিয়রদের জিজ্ঞাসা করতে করতে পারেন, ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স থেকে স্নাতক সমতুল্য ডিগ্রি পাওয়া যায়, একই সিলেবাস যদি হয়, সেখানে কেন পাসের হার খুব খারাপ হয়? আমরা মান নিয়ন্ত্রণ না করে আরও ৫ লাখের বেশি মানুষকে সহজলভ্য সার্টিফিকেট বিতরণের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু হওয়া উচিত ছিল মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের সব মেগা প্রজেক্ট দেশীয় প্রকৌশলীদের দিয়ে করানো। তাঁরাই হতে পারতেন আমাদের ভবিষ্যতের সারথি।
দেশে এখন নিশ্চলতাস্ফীতি চলছে। শিক্ষিত বেকার তৈরিতে বাংলাদেশ প্রথম সারির। এর মধ্যে যদি পড়াশোনা ছাড়াই আরও ৫ লাখ নতুন ডিগ্রিধারী স্নাতক তৈরি করা হয়, তাহলে অবস্থা কী হবে, তা ভেবে দেখেন তো?
হ্যাঁ! স্নাতক হতে লাগে ১৬ বছরের পড়াশোনা, সেখানে ডিপ্লোমাদের আছে ১৪ বছরের। প্রকৌশলী হতে হলে সারা বিশ্বেই ১৬ বছরের শিক্ষা দরকার, তারপর লাগে অভিজ্ঞতা। বিশ্বে কোথাও বিএসসি (পাস) ইঞ্জিনিয়ার বলে কিছু নেই। আর হ্যাঁ, সব দেশেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়েই পড়ার সুযোগ পেতে হয়।
সবার জন্য সব শিক্ষা না, মেধার যোগ্যতাসম্পন্নদের জন্যই শিক্ষা। যদিও মানহীন কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমাদের দেশে এই মান পড়তির দিকে, সেখানে নতুন করে ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীদের কী হবে, তা বুঝতে আসলে খুব বেশি ঘাঁটতে হয় না। আর শুধু অভিজ্ঞতা দিয়ে স্নাতক (পাস) ডিগ্রি পাওয়া গেলে বাকি যাঁরা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন উচ্চমাধ্যমিক পাস শিক্ষার্থী আছেন, তাঁদের জন্য দ্বৈত আইন হবে না? দেশের চাকরির বাজারে বেতন নেমে কোথায় যাবে, চিন্তা করতে পারেন?
এই আত্মবিধ্বংসী কাজ না করে বরং ডিপ্লোমাদের সিলেবাস এবং ব্যবহারিক সুবিধা উন্নয়ন করে তাদের বাস্তব দুনিয়ার কাছাকাছি নিয়ে আসাটাই দেশের জন্য বেশি জরুরি। তাদের জন্য আরও সফট স্কিলের ট্রেনিংও দরকার।
প্রকৌশলীদের ও প্রকৌশল শিক্ষার মানের ক্রমাগত অবনমন দেশের টেকসই উন্নয়নের পথে অন্তরায়ই শুধু নয়, ভবিষ্যতের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তি তৈরি ও নলেজ–বেজড সোসাইটি বিনির্মাণে বড় প্রতিবন্ধকতা। যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের নামে এই ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা বরং কোনো কাজে আসার থেকে আমাদের আরও পিছিয়ে ফেলবে।
অবিলম্বে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাতিল করে, শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ করা উচিত।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট।
ই–মেইল: [email protected]