রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের পাইলট উদ্যোগ নিয়ে এগোনোর পথ ধরেছে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছে সরকার। ১৯ মে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ এই সমর্থন চেয়েছে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আবদুল মুহিত বলেন, ‘আমরা জাতিসংঘ, আসিয়ান এবং আঞ্চলিক দেশগুলোকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য হাতে নেওয়া পাইলট প্রকল্পের সমর্থন করতে এবং এ প্রকল্পের আওতায় প্রত্যাবাসিত হতে যাওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের সমাজে পুনরায় একীভূত হতে সহায়তা করতে আহ্বান জানাই।’
প্রশ্ন হচ্ছে মিয়ানমারের এই উদ্যোগ নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানা প্রশ্ন, সন্দেহ ও অবিশ্বাস থাকার পরও বাংলাদেশ কেন এমন একটি উদ্যোগে শামিল হতে যাচ্ছে?
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহী—এমন খবর দেশটির সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এরই মধ্যে ধারাবাহিক কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে। মিয়ানমার সরকার গত মার্চে বাংলাদেশসহ চীন, ভারত ও আসিয়ান দেশগুলোর কূটনীতিকদের রাখাইন রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তারা কী কী উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা দেখানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। এরপর তারা কক্সবাজারে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ে।
প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্পে হাজারখানেক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে প্রায় সাত শ জনকে বাছাই করেছে। তবে মাঝে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মাসুদ বিন মোমেনের মুখ থেকে আমরা শুনেছি, জাতিসংঘ বা আসিয়ানের মতো সংস্থা এ প্রক্রিয়ায় সমর্থন দেয়নি এবং যেহেতু তাদের মধ্যস্থতার প্রয়োজন, তাই এ পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে।
কিন্তু সেই প্রক্রিয়া থেমে থাকেনি। মে মাসের শুরুতে রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি আছে কি না, তা দেখতে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদল সেখানে গিয়েছিল। ফিরে এসে তারা বলেছে, সেখানে প্রত্যাবাসনের পরিবেশ ও পরিস্থিতি কোনোটাই নেই।
বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এই সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমছে। এই চাপ নেওয়া আমাদের পক্ষে দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চীনের সমর্থন বা আশ্বাসে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে, তাতে কোনো কাজ হবে বলে মনে না, যেমন গত ছয় বছর ধরে হয়নি।
রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বলেছেন, তাঁদের জন্মভিটায় সেনা ব্যারাক, পুলিশ ফাঁড়ি, সীমান্ত চৌকিসহ নানা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে সেখান যে মডেল গ্রাম তৈরি হচ্ছে, তারা সেখানে ফিরতে রাজি নন। এই যখন রোহিঙ্গাদের মনোভাব, তখন বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের পাইলট উদ্যোগ নিয়ে এগোয় কীভাবে?
এর আগে মার্চ মাসে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বলেছে, সেখানকার পরিস্থিতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল নয়। তারা এটাও স্পষ্ট করেছে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের আলোচনায় তারা জড়িত নয়। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় পাইলট প্রকল্পের আওতায় এসব হচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের এই নতুন উদ্যোগ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ঠিকই, কিন্তু এর পেছনে আগের মতোই মূল ভূমিকা পালন করছে চীন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের এই তৃতীয় দফা উদ্যোগ শুরুর পথ থেকেই এর উদ্দেশ্য নিয়ে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। হঠাৎ এই উদ্যোগের পেছনে আসলে কী আছে? মিয়ানমার কি আসলেই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তারা কি আন্তরিক, নাকি এটা একটা কৌশল? অনেকের মতে প্রত্যাবাসনের এই পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে মিয়ানমার বাংলাদেশকে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ কেন এই ফাঁদে পা দেবে?
এসব প্রশ্ন ওঠার যৌক্তিক ও বাস্তব কারণ রয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্টে গণহত্যা ও অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর যে ঢল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে নেমেছিল, তার তিন মাসের মাথায় এই ‘বাস্তুচ্যুত’ জনগণকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। তখনো এই চুক্তির পেছনে ছিল চীন, কিন্তু তারা কোনো দায় নেয়নি। তারা নিজেরাও আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তির অংশ হয়নি, এর কোনো আন্তর্জাতিক গ্যারান্টিও ছিল না। ২০১৭ সালের নভেম্বরে স্বাক্ষরিত সেই চুক্তির ফলাফল কী, তা আমাদের জানা।
চুক্তি অনুযায়ী এক বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। এরপর ২০১৯ সালে চীনের তরফে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নতুন একটি উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। সেটাও ফল দেয়নি। গত ছয় বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ফলাফল শূন্য। এখন নতুন করে আবার যে পাইলট প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তার ওপর আস্থা বা ভরসা রাখার ন্যূনতম কোনো কারণ আছে কি?
দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন বারবার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে এবং বাংলাদেশ তাতে আস্থা রাখছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের ভূমিকা আসলে কী? চীন সব সময়েই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন-নির্যাতন বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে; কিন্তু চীনের তরফে এর প্রতিবাদ তো দূরে থাক, নিন্দাও শোনা যায়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চীনের আন্তরিকতা নিয়ে তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
রাখাইন রাজ্য ও রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমারের কৌশল পরিষ্কার। তারা এই রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে চায়। সেই বিবেচনা থেকে তারা ধারাবাহিকভাবে এই জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার–নির্যাতন চালিয়ে আসছে। দেশটির নাগরিকত্ব আইন পুরোপুরি রোহিঙ্গাবিদ্বেষী এবং তাদের নাগরিক হিসেবেই স্বীকার করা হয় না। আরাকান থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের চেষ্টাও নতুন কিছু নয়, এটা ২০১৭ সালের আগস্টের বিষয় নয়। এর আগেও তারা দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠিয়েছে এবং প্রত্যাবাসনের নামে সময়ক্ষেপণ করেছে। যখনই কোনো আন্তর্জাতিক চাপের পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখনই এ ধরনের উদ্যোগ সামনে চলে আসে। মিয়ানমার সরকারের এই কৌশল বুঝতে আমাদের এত কষ্ট হচ্ছে কেন?
রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, তা থেকে আমরা কোনো শিক্ষা নিয়েছি বলে মনে হয় না। আমরা সম্ভবত আবারও চীনের কথায় বিশ্বাস করে ভাবতে বসেছি মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। আমরা আবার দ্বিপক্ষীয়ভাবে এগোচ্ছি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা প্রস্তুত করে আমরা হাজারখানেক রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসে বিরাট স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি! আমরা এই দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন চাওয়ার পথ ধরেছি!
বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এই সংখ্যা বছর বছর বাড়ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমছে। এই চাপ নেওয়া আমাদের পক্ষে দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরানোর বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চীনের সমর্থন বা আশ্বাসে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে, তাতে কোনো কাজ হবে বলে মনে না, যেমন গত ছয় বছর ধরে হয়নি।
রোহিঙ্গা ইস্যু এখন শুধু বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের বিষয় নয়। এই অঞ্চলকে ঘিরে ভূরাজনীতি যে নতুন মাত্রা পেয়েছে, তাতে আমরা চাই বা না চাই, রোহিঙ্গা ইস্যু বৈশ্বিক ভূরাজনীতির একটি অংশে পরিণত হয়েছে। গত ডিসেম্বরে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ বিল পাস হয়েছে সিনেটে এবং তা ২০২৩ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও মিয়ানমারের বিষয় নয়। এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে এর বড় প্রভাব পড়বে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। রোহিঙ্গা ইস্যুকে তাই সামগ্রিক বিবেচনায় দেখতে হবে।
এত দিনে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে রোহিঙ্গাদের ফেরাতে হলে যা দরকার, তা হচ্ছে মিয়ানমারের ওপর জোরদার আন্তর্জাতিক চাপ। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুক্ত না করে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কোনো উদ্যোগ তাই কোনো কাজে দেওয়ার কথা নয়। বরং এমন কিছু করলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের প্রতি যে সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে, তা হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপ–সম্পাদক
ই–মেইল: [email protected]