বিতর্কিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ রহিত করে যে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩’-এর খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছে, অনেকেই সেই আইনটিকে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির ওয়েবসাইটে দেওয়া নতুন আইনটির খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আইনটিকে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ না বলে ‘পুরোনো বোতলে পুরোনো মদ’ বলাই যথাযথ হবে। শুধু বোতলের অ্যালকোহলের পরিমাণ কিছুটা কমানো হয়েছে এবং বোতলের লেবেল বা নাম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর যে ৯টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত, সেগুলো হলো ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এ এই সব কটি ধারাই রয়েছে।
এসব ধারার মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের তথ্য, সংবাদ ও মতপ্রকাশকে যেভাবে অপরাধ হিসেবে ধরা হয়েছিল, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে তা প্রায় হুবহু অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। অপরাধের সংজ্ঞাও আগের মতোই অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। শুধু পার্থক্য হলো, কয়েকটি ধারাকে জামিন অযোগ্য থেকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে, সাজার ধরন পরিবর্তন ও সাজার পরিমাণ কমানো হয়েছে, একই অপরাধ বারবার করার দায়ে বাড়তি শাস্তির বিধান বাদ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাবিরোধী নয়টি ধারার মধ্যে সাতটি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধন আনা হয়েছে। আর দুটি ধারায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮ ধারায় আদালতের অনুমোদন ছাড়াই বিটিআরসির মাধ্যমে ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার যে ক্ষমতা ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেওয়া হয়েছিল, সাইবার নিরাপত্তা আইনে তা অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। একইভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ ধরায় পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের যে ক্ষমতা পুলিশের ছিল, সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪২ ধারায় তা অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রচারণার অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল, সাইবার নিরাপত্তা আইনে এটি কমিয়ে ৭ বছর করা হচ্ছে।
২৮ ধারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের দায়ে সাজা কমিয়ে পাঁচ থেকে দুই বছর এবং জামিন অযোগ্য থেকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে।
২৯ ধারায় মানহানির অপরাধে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল, নতুন আইনে এ ধারায় কারাদণ্ড বাতিল করে জরিমানা বাড়িয়ে ২৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। অবশ্য সেই জরিমানা অনাদায়ে তিন থেকে ছয় মাসের কারাদণ্ড থাকবে।
৩১ ধারায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগে সাত বছরের বদলে পাঁচ বছর কারাদণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে। ৩২ ধারায় সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের শাস্তি আগে ছিল ১৪ বছর, সেটি কমিয়ে ৭ বছর করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ বাতিল করার কথা বলা হলেও এই আইনের অধীন বিদ্যমান তদন্ত ও বিচারাধীন সব মামলার কার্যক্রম চলমান রাখার কথা বলা হয়েছে।
এ অবস্থায় ইতিপূর্বে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারা বাতিল করার অভিজ্ঞতার যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী? সমালোচনার মুখে সরকার আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল করলেও সেই বাতিলকৃত ধারার সব কটি বিষয়কেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর চারটি ধারার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখনো শাস্তি ও জামিন বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের সংশোধনী আনা হয়েছিল। সে সময়ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নতুন আইনের মাধ্যমে বাক্স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে আশ্বস্ত করেছিলেন:
‘আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা যেভাবে আছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা সেভাবে থাকছে না। বাক্স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য যেসব চেক অ্যান্ড ব্যালান্স দরকার, সেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়াও সম্প্রচার আইনেও থাকবে।’
বাস্তবে দেখা গেল, ৫৭ ধারা বাতিল করে তৈরি করা নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও হয়রানি আরও বেড়ে যায়। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডির দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত আইসিটি অ্যাক্টে মামলা হয়েছিল ১ হাজার ৪১৭টি, যার ৬৫ শতাংশ মামলা ছিল ৫৭ ধারায়। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার মাত্র দুই বছরের মধ্যেই এই আইনে মামলার সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়, যার বেশির ভাগই করা হয় আইনটির ২৫ ও ২৯ ধারায়, মূলত রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও মানহানির অভিযোগে।
কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, মানহানি, মিথ্যা তথ্য প্রচার, অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ইত্যাদি বিষয়কে এভাবে অপরাধীকরণ করা হয় না। কোনো লেখা বা বক্তব্য কারও কাছে আপত্তিকর মনে হলে পাল্টাবক্তব্য ও লেখার মাধ্যমেই তার মোকাবিলা করা হয়, পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে শায়েস্তা করা হয় না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার আগে এই রকম অভিযোগে মামলা হতো আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায়। সমকালে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মোট মামলার সংখ্যা ৭ হাজার ৬৬৪, যার মধ্যে ৫ হাজার ৫১২টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন।
আগের আইনগুলোর মতো সাইবার নিরাপত্তা আইনেও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, মানহানি, মিথ্যা তথ্য প্রচার, অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে যেকোনো ব্যক্তির মামলার সুযোগ থেকে যাওয়ার কারণে নতুন আইনেও মামলা কমবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানি ও নিপীড়ন শুরু হয় বিচারের আগেই। কারণ, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিচারের আগেই দিনের পর দিন জেল খাটতে হয়। তাহলে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে সাজা কমানো হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির কী লাভ হবে? জামিনযোগ্য হলেও জামিন পাওয়ার কি কোনো নিশ্চয়তা থাকবে? নতুন আইনে ছয়টি ধারা জামিন অযোগ্য। মামলা করার সময় জামিন অযোগ্য ধারা যুক্ত করে দিলেই কেল্লাফতে।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপপ্রচারের অভিযোগে ২০২০ সালের মে মাসে গ্রেপ্তার হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ ছয়বার জামিন চেয়েও পাননি, বিনা বিচারে নয় মাস জেল খেটে জেলের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগে ২০২২ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা, যিনি প্রায় এক বছর ধরে জেলে আছেন, সেটাও তো বিচারের আগে। হাইকোর্ট তাঁকে জামিন দিলেও সুপ্রিম কোর্টে তা স্থগিত হয়ে আছে, এমনকি তাঁর জামিনের শুনানিই স্থগিত করে রাখা হয়েছে নভেম্বর পর্যন্ত। তাহলে এই ধরনের মামলার সাজা কমালে বা জামিনযোগ্য করলে খাদিজার মতো বন্দীদের কী লাভ হবে?
হয়রানি ও নিপীড়ন যা হওয়ার তা তো বিচারের আগেই হয়ে যাবে, দিনের পর দিন জেলে বন্দী থাকতে থাকতে। কাজেই সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় কয়েকটি ধারার শাস্তির মেয়াদ কমানো বা কয়েকটি ধারা জামিনযোগ্য করার মধ্যে দিয়ে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল সমস্যা ছিল ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, মানহানি, মিথ্যা তথ্য প্রচার, অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ইত্যাদি বিষয়কে ক্রিমিনালাইজ করা বা ফৌজদারি অপরাধের আওতার মধ্যে ফেলা।
কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, মানহানি, মিথ্যা তথ্য প্রচার, অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া ইত্যাদি বিষয়কে এভাবে অপরাধীকরণ করা হয় না। কোনো লেখা বা বক্তব্য কারও কাছে আপত্তিকর মনে হলে পাল্টাবক্তব্য ও লেখার মাধ্যমেই তার মোকাবিলা করা হয়, পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে জেলে ঢুকিয়ে শায়েস্তা করা হয় না।
স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে কম্পিউটার ও ডিজিটাল ডিভাইসে বেআইনি প্রবেশ, ক্ষতিসাধন, সোর্স কোড পরিবর্তন, হ্যাকিং, ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক জালিয়াতি ও প্রতারণা, ব্যক্তিগত তথ্য চুরি ইত্যাদি অপরাধ বিষয়ে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
কাজেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পুরোপুরি বাতিল করে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী ধারাগুলো সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে কেবল সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত সাইবার অপরাধ দমনের জন্য আইন করতে হবে। সেই সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চলমান সব মামলা বাতিল করতে হবে এবং এই মামলার কারণে জেলবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ।’
ই-মেইল: [email protected]