স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগস্টের ২৯ তারিখে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন।
কমিটিকে সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে বাংলাদেশের অর্থনীতির হালহকিকত গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তিন মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কমিটি ১ ডিসেম্বর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের শ্বেতপত্রটির খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। শ্বেতপত্রটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘উন্নয়ন বয়ানের ব্যবচ্ছেদ’ (ডিসসেকশান অব আ ডেভেলপমেন্ট ন্যারেটিভ)। প্রায় ৩৯৬ পৃষ্ঠার খসড়া প্রতিবেদনে রয়েছে ২৪টি অধ্যায়। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দাবি করেছেন যে হাসিনার শাসনামলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ‘চামচা পুঁজিবাদ’ (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) থেকে সরাসরি ‘চোরতন্ত্রে’ (ক্লেপ্টোক্রেসি) রূপান্তরিত হয়েছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা ভূমিধস বিজয় অর্জন করেন। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের লাগামহীন তৎপরতা শুরু করেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন। কেউ কেউ বলেন যে এই প্রক্রিয়ায় সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী উৎসাহিত করতেন। এই শ্বেতপত্র হাসিনার কথিত উন্নয়ন বয়ানের আড়ালে লুকানো ‘অবিশ্বাস্য লুটপাটতন্ত্রের একটি নির্মোহ ব্যবচ্ছেদের দলিল’ হিসেবে টিকে থাকবে। শ্বেতপত্রের একটি নির্মোহ ব্যবচ্ছেদ করলে নিচের বিষয়গুলো প্রধানভাবে উঠে আসবে।
এক.
শ্বেতপত্র কমিটির গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বৈরশাসক হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের লুটপাটতন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুণ্ঠিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়েছে। সবচেয়ে বেশি লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, ভৌত অবকাঠামো এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাত। শ্বেতপত্রে খাতওয়ারি লুণ্ঠনের তথ্য-উপাত্ত উদ্ঘাটন করে লুণ্ঠিত অর্থের প্রাক্কলন প্রকাশ করা হয়েছে।
শ্বেতপত্রে মোট ২৮টি দুর্নীতির পদ্ধতির মাধ্যমে লুণ্ঠন প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণে নিয়ে আসা হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, ভারত ও কয়েকটি ‘ট্যাক্স হেভেন’ সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। লুটেরা রাজনীতিবিদদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় অলিগার্ক ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের খেলোয়াড়, দুর্নীতিবাজ আমলা, ঠিকাদার ও মধ্যস্বত্বভোগী, হাসিনার আত্মীয়স্বজন এবং ‘ইনফ্লুয়েন্স প্যাডলার’ ও ‘হুইলার-ডিলাররা’ এই লুটপাটতন্ত্রের প্রধান চরিত্র।
এই লুটেরারা পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে দেশের নির্বাহী বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো, সরকারি রাজস্ব আহরণ বিভাগগুলো ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগগুলোকে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফায়দা হাসিলের অংশীদার করে ফেলেছে। দেশের বিনিয়োগ ও রাজস্ব আহরণকে তারা দুর্বল করে ফেলেছে। ধস নামিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনকে তছনছ করে দিয়েছে।
দুই.
কানাডায় ৪৭ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। দুবাইয়ে ৯৭২ জন বাংলাদেশির রিয়েল এস্টেট সম্পত্তি রয়েছে। মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ কার্যক্রমে ঘরবাড়ি কিনেছেন ন্যূনতম ৩ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে প্রতিবছর গড়ে ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
তিন.
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামালের নির্দেশে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৪ সাল থেকে ‘উপাত্ত কারসাজি’–এর কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রতিবছর জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। একই সঙ্গে মাথাপিছু জিডিপি বাড়িয়ে দেখানোর জন্য দেশের মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে।
বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে দেশের রপ্তানি আয়কে। মূল্যস্ফীতির হারকে সব সময় কমিয়ে দেখানো হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যাকে কম দেখানো হয়েছে, যাতে দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানো যায়।
দেশের জনগণের জন্মহার ও মৃত্যুহারকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে কমিয়ে দেখানো যায়। একই সঙ্গে দেশের ‘টোটাল ফার্টিলিটি রেট’কে কম দেখানো হয়েছে, যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সরকার সফল হচ্ছে বলে প্রচার করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় আগের বছরে সাবেক সরকার যতখানি দেখিয়েছিল, তার চেয়ে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।
চার.
দেশের সাতটি মেগা প্রকল্পের ব্যয় প্রাথমিক প্রাক্কলনের চেয়ে ৭০ শতাংশ বাড়িয়ে অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। এর আনুমানিক পরিমাণ ৮০ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। এই মেগা প্রকল্পগুলো হচ্ছে পদ্মা সেতু প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মাওয়া-যশোর-পায়রা রেলপথ প্রকল্প, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্প, পায়রা বন্দর প্রকল্প ও মাতারবাড়ী কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোর যথাযথ ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ও ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ না করার কারণে এই ৭০ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির অজুহাত সৃষ্টি হয়েছে।
পাঁচ.
দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ পৌনে সাত লাখ কোটি টাকা। শ্বেতপত্র কমিটি প্রকৃত খেলাপি ঋণকে ‘ডিসট্রেসড অ্যাসেট’ নামে অভিহিত করেছে। শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়েছে যে এই ডিসট্রেসড অ্যাসেট দিয়ে সাড়ে ১৩টি মেট্রোরেল কিংবা সাড়ে ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। অবৈধ হুন্ডি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৪ লাখ কোটি টাকা। ১০টি ব্যাংক ‘টেকনিক্যালি দেউলিয়া’ হয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে দুটি ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত আর বাকি আটটা ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক। এগুলোতে তারল্যসংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
বড় ধরনের ঋণ লুটপাটের শিকার হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ও বেসিক ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংক ও অন্য শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলো থেকে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংকঋণ, প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে লুটেরারা।
ছয়.
দেশের শেয়ারবাজার থেকে কমপক্ষে ২৭ বিলিয়ন ডলার সরাসরি আত্মসাৎ করা হয়েছে। নানা রকম কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে এক ট্রিলিয়ন টাকার (এক লাখ কোটি) বেশি লুটপাট করেছে কয়েকজন চিহ্নিত ব্যক্তি। ২০১০-১১ সালের শেয়ারবাজারের পরিকল্পিত ধসের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত কমিটির রিপোর্টকে কোনো পাত্তা দেওয়া হয়নি। ফলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে হারিয়ে ফেলেছে।
সাত.
দেশের জনগণের আয়বৈষম্য-পরিমাপক জিনি সহগ ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। বিশ্বব্যাংকের জরিপে যে ৭২টি দেশ তাদের আয়বৈষম্য রিপোর্ট করেছে, তার মধ্যে এর চেয়ে বেশি জিনি সহগের মান ব্রাজিল, কলম্বিয়া ও পানামা—এই তিন দেশে বিদ্যমান। তার চেয়েও ভয়াবহ অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশের সম্পদবৈষম্যের পরিমাপক জিনি সহগ, ২০১৬ থেকে ২০২২ সালে যেটা শূন্য দশমিক ৮২ থেকে শূন্য দশমিক ৮৪–এ পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ এখন একটি মারাত্মক উচ্চ আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্যের দেশ।
আট.
দেশের মাথাপিছু প্রবৃদ্ধির হারকে ১৯৯৫ সাল থেকে কয়েক শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। এ জন্য উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের অনেকে বাংলাদেশের এই জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ‘প্যারাডক্স’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। স্বৈরশাসকের পতনের পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাবেক সরকারের প্রক্ষেপিত ৬ দশমিক ৫ শতাংশের চেয়ে কমে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে এসে দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
নয়.
আনুমানিক ৭৭ হাজার কোটি থেকে ৯৮ হাজার কোটি টাকা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের কবজায় চলে গেছে বলে শ্বেতপত্রে জানানো হয়েছে। ৭০ হাজার কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজনীতিবিদদের করায়ত্ত হয়েছে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। এই আমলা ও রাজনীতিবিদদের স্ত্রী-সন্তানেরা পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে।
● ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক