শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন, যাঁকে হাসিনা ক্রমাগত হয়রানি করেছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রথম দিকে রাস্তায় গন্ডগোল ও সহিংসতা দেখা গেলেও নতুন সরকার দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব আরোপ শুরু করেছে। প্রতিবাদী শিক্ষার্থী, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস বাংলাদেশ ‘দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন’ করেছে উল্লেখ করে এই দিনকে ‘আমাদের গর্বের’ বলে ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করে। হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনাকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘আমাদের এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে।’
তাঁর বক্তব্য জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। গত ১৫ বছর হাসিনার শাসনামলকে চিহ্নিত করা হয় মূলত বাক্স্বাধীনতার চরম লঙ্ঘন, রাষ্ট্রের নেতৃত্বে জোরপূর্বক গুম, রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচকদের বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং ব্যাপক ভোট কারচুপির আমল হিসেবে।
ছাত্রদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সে সময় ৩২ শিশু, ৪৪ জন পুলিশ সদস্যসহ শত শত সাধারণ মানুষ নিহত হন। সেই সঙ্গে পুলিশের তৎপরতায় (গুলি ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে) কয়েক হাজার মানুষ আহত হন। এক সপ্তাহের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ থাকে এবং টেলিযোগাযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
আন্দোলন দমনের জন্য হাসিনা যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেগুলোর চিত্র ছিল ভয়াবহ। রাষ্ট্রীয় বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে। স্নাইপাররাও আন্দোলনকারীদের গুলি করেছে এবং জনগণকে আতঙ্কিত করতে রাতবিরেতে নির্বিচার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবু শিশু-নারীসহ আপামর জনসাধারণ হাসিনার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে গেছেন।
আশার খবর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুম হওয়া মানুষগুলোর কি হয়েছিল, কাদের আদেশে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল— এ সব বের করার জন্য একটি কমিশন করতে যাচ্ছে। এই উদ্যেগকে সাধুবাদ জানাতে হয়। আশা করব যেন এই কমিশনে গুমের শিকার হয়ে ফিরে আসা ভুক্তভোগী ব্যক্তি এবং যারা এখনো ফেরত আসতে পারেনি সেই পরিবারের সদস্যরা এবং মায়ের ডাকের সদস্যরা যেন থাকেন। কমিশন যেন শুধু আমলা ও মানবাধিকারকর্মী নির্ভর না হয়ে যায়।
ড. ইউনূসের প্রশাসনের ওপর জনগণের প্রত্যাশা এখন অনেক বেশি। সে জন্য জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য একটি জাতীয় কমিশন গঠন করা। সাত শতাধিক বাংলাদেশি জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন। তাঁদের কয়েকজন ফিরেছেন, বাকিরা এখনো ফেরেননি।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে জোরপূর্বক নিখোঁজ হওয়া বলতে বোঝায় এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সেই ব্যক্তিকে আটক করার বিষয়টি অস্বীকার করে। ফলে এই পুরো প্রক্রিয়াটি অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
হাসিনা সরকারের পতনের পর জোরপূর্বক গুমের শিকার হওয়া তিনজন বাংলাদেশি মুক্ত হন। এই তিনজন হলেন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আজমী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আহমেদ বিন কাশেম ও আদিবাসী আন্দোলনকর্মী মাইকেল চাকমা।
হাসিনার শাসনামলের অবৈধ গোপন বন্দিশালা থেকে আট বছর পর মুক্তি পান আজমী ও আরমান এবং মাইকেল চাকমা পাঁচ বছর পর মুক্তি পান। তিনজনই বলেছেন যে তাঁরা কবরের মতো অবস্থায় আটক ছিলেন, যেখানে সূর্যের আলো দূরের কথা, কোনো আলোই ছিল না এবং বেশির ভাগ সময় তাঁদের হাত বাঁধা ও চোখে পট্টি লাগানো থাকত।
এই তিন বন্দীর মুক্তির পর এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে যে এত দিন ধরে মানবাধিকার সংগঠনগুলো যে অভিযোগ করে আসছিল, তা সত্যি। সংগঠনগুলোর অভিযোগ ছিল, সরকারবিরোধী ও সমালোচকদের দমন করার জন্য জোরপূর্বক গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছিল হাসিনার সরকার।
ছাত্রদের এই আন্দোলনের সময়ও কয়েকজন ছাত্রনেতাকে অল্প সময়ের জন্য জোরপূর্বক গুম করা হয়েছিল, তবে তাঁদের দ্রুতই মুক্তি দেওয়া হয়।
হাসিনার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের অন্যতম একটি কারণ হলো সমালোচনাকে দমন করতে জোরপূর্বক গুমের ঘটনাগুলো। আর তাই ড. ইউনূসের সরকারের উচিত রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের এই ব্যবস্থাকে যথাযথভাবে বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া শুরু করা।
১৯৭৬-১৯৮৩ সালের মধ্যে আর্জেন্টিনায় হাজার হাজার নাগরিকের জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা তদন্তে যে কমিশন গঠন করেছিল, প্রস্তাবিত জাতীয় কমিশন সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে। আর্জেন্টিনার জাতীয় কমিশন প্রথমে গবেষকদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছিল, যে দলটি অপরাধীদের বিষয়ে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। যারা গুমের নির্দেশ দিয়েছিল, যারা অপহরণ করেছিল, নির্যাতনে অংশ নিয়েছিল এবং অবৈধভাবে আটক করেছিল—তাদের অপরাধী করা হয়।
এই কমিশন ‘নুনকা মাস’ (আর কখনো না) শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, যেটি আর্জেন্টিনায় সামরিক জেনারেলদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করার যৌক্তিকতার ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল।
ড. ইউনূসের সরকার আর্জেন্টিনার উদাহরণ অনুসরণ করে বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম হওয়া প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিয়ে তদন্ত করার জন্য গবেষকদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করতে পারে।
গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তি যাঁরা মুক্ত হয়েছেন ও জীবিত আছেন এবং ফিরে না আসা ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের এটা জানার অধিকার আছে যে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে আসলে কী হয়েছে। তাঁদের এটাও জানার অধিকার আছে যে কারা এই নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলোর নির্দেশদাতা, কতটি গোপন বন্দিশালা বাংলাদেশে আছে এবং কোন রাষ্ট্রীয় বাহিনী এই গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে যুক্ত।
রাষ্ট্রের যে কর্মকর্তারা এ ধরনের মানবতাবিরোধী গুরুতর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের বিচার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হওয়া উচিত।
যদিও ড. ইউনূস অনেক জনপ্রিয় কিন্তু দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের জনসাধারণের ম্যান্ডেট নেই। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিকে ড. ইউনূসের নজর রাখতে হবে।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিরোধী দল বিএনপি ইতিমধ্যে মৃদু চাপ তৈরি করেছে। অবশ্য অন্যরা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা উচিত এবং নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার আগে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সংস্কার চালিয়ে যাওয়া উচিত।
পরিবর্তন আনার জন্য ড. ইউনূসের হাতে সময় খুব সীমিত। সে জন্য অন্তত গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। তবে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে কমিশন যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং কমিশনের কাজে কোনো সরকার হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
আশার খবর যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গুম হওয়া মানুষগুলোর কি হয়েছিল, কাদের আদেশে তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল— এ সব বের করার জন্য একটি কমিশন করতে যাচ্ছে।
এই উদ্যেগকে সাধুবাদ জানাতে হয়। আশা করব যেন এই কমিশনে গুমের শিকার হয়ে ফিরে আসা ভুক্তভোগী ব্যক্তি এবং যারা এখনো ফেরত আসতে পারেনি সেই পরিবারের সদস্যরা এবং মায়ের ডাকের সদস্যরা যেন থাকেন। কমিশন যেন শুধু আমলা ও মানবাধিকারকর্মী নির্ভর না হয়ে যায়।
মোবাশ্বার হাসান, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ
দ্য ডিপ্লোম্যাটে প্রকাশিত, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মাইদুল ইসলাম